লেবাননের দক্ষিণ বৈরুতে টানা ১১টি বিমান হামলা
ইসরায়েল গতকাল বৃহস্পতিবার লেবাননের দক্ষিণ বৈরুতে টানা ১১টি বিমান হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনা হিজবুল্লাহ সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে। সূত্রটির মতে, এই হামলা ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযানের অংশ, যা গত সপ্তাহ থেকে লেবাননে শুরু হয়েছে। এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ বৈরুত, যা হিজবুল্লাহর শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, মূলত এই হামলার লক্ষ্য ছিল।
ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহ, যেটি একটি সশস্ত্র শিয়া রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত, লেবাননের দক্ষিণে বেশ প্রভাবশালী। ১৯৮০-এর দশক থেকে হিজবুল্লাহর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সামরিক কার্যক্রম চলছে। ফলে, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘাত প্রায়শই প্রকাশ্যে আসে।
গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান লেবাননের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বেশ জোরালো হয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, হিজবুল্লাহর প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে এই অভিযান চালানো হচ্ছে। হিজবুল্লাহ, যদিও, বরাবরই নিজেদের কার্যক্রমকে প্রতিরোধমূলক এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনের জবাব হিসেবে উপস্থাপন করে।
বৈরুতের দক্ষিণ অংশ হিজবুল্লাহর প্রধান ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তু হয়ে আসছে। হিজবুল্লাহর মূল রাজনৈতিক ও সামরিক কেন্দ্রসমূহ এখানেই অবস্থান করছে, এবং সংগঠনটি এখান থেকে নিজেদের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
ইসরায়েলের বিমান হামলার মূল লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহর এই ঘাঁটি। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, হামলায় বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দক্ষিণ বৈরুতের বিভিন্ন স্থাপনা, বিশেষ করে হিজবুল্লাহর সামরিক স্থাপনা, এই হামলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
লেবাননের রাজধানী বৈরুত ও তার আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত এএফপির প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তারা বিস্ফোরণের ভয়াবহ আওয়াজ শুনেছেন। এই শব্দগুলি বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠ থেকে আসছিল, যেখানে হিজবুল্লাহর ঘাঁটি অবস্থিত। এসব বিস্ফোরণের আওয়াজ এতটাই তীব্র ছিল যে শহরের বেশিরভাগ এলাকায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যদিও বৈরুতের মূল শহর কেন্দ্র এই হামলা থেকে মুক্ত ছিল, তবে কাছাকাছি এলাকা থেকেই এই আওয়াজগুলো শোনা গিয়েছিল।
এএফপি জানিয়েছে, এই হামলার সময় স্থানীয় জনগণ এলাকায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করেছে। স্থানীয় হাসপাতাল ও জরুরি পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় ছিল, এবং আহতদের দ্রুত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। বৈরুতের জনগণ এই ধরনের সহিংসতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলেও, এমন ভয়াবহ হামলা খুবই কম দেখা যায়।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বৈরুতের হাদাথ অঞ্চলের বাসিন্দাদের এলাকা খালি করার নির্দেশ দিয়েছে। স্থানীয় সূত্রমতে, এই নির্দেশ হামলার কিছুক্ষণ আগেই দেওয়া হয়েছিল। বাসিন্দাদের দ্রুত এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়, যার ফলে অনেকেই নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সক্ষম হয়েছেন। ইসরায়েল তাদের অভিযানকে সফলভাবে পরিচালনার জন্য এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, বিশেষ করে যেখানে তারা বড় ধরনের হামলা পরিচালনা করে।
এই বিমান হামলার পর থেকে লেবাননের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিবেশ বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো আসেনি, তবে সংগঠনটি প্রায়ই ইসরায়েলের আক্রমণের জবাবে পাল্টা হামলা চালিয়ে থাকে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত খবরে বলা হয়েছে, হিজবুল্লাহর শীর্ষস্থানীয় নেতারা এই হামলার পরপরই জরুরি বৈঠকে বসেছেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছেন।
আরো পড়ুন ….তীব্র হচ্ছে ইরান -ইসরাইল যুদ্ধ
অন্যদিকে, লেবাননের সরকার এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের এই ধরনের আক্রমণকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে। লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, “এই আক্রমণ আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। আমরা আমাদের দেশকে রক্ষার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
ইসরায়েল ও লেবাননের এই সংঘাত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বেশ কয়েকটি দেশ এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় দেশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং সংঘাত থামানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের এই সহিংসতা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি স্বরূপ।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের বিমান হামলা ও সামরিক অভিযান লেবানন-ইসরায়েল সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ রয়েছে। হিজবুল্লাহ যদি পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে এই সংঘাত আরও ব্যাপক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই হামলা ও সংঘাতের ফলাফল লেবানন ও ইসরায়েলের জনগণের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই সংঘাতের কারণে দুই দেশের সাধারণ মানুষ ভুগছে। যুদ্ধের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি, জীবনযাত্রা, এবং সামাজিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে লেবাননের দক্ষিণ অঞ্চল, যেখানে হিজবুল্লাহর প্রভাব বেশি, সেই এলাকায় বেসামরিক মানুষের জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘাত আরও তীব্র হয়, তাহলে এটি শুধুমাত্র এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলার পর এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইসরায়েলের এই হামলা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিবেশ আরও অস্থির হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে এই সংঘাতের সমাধান দ্রুত না হলে আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখা কঠিন হয়ে যাবে। ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও হিজবুল্লাহর প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের ফলে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে সহিংসতা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নতুন করে সংঘাত এড়ানোর জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়ানো এবং উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরু করা অত্যন্ত জরুরি। তবে, ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে কী ঘটতে পারে, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।
Leave a Reply