আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১১ পূর্বাহ্ন
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া: আদানি চুক্তি ও বৈষম্যমূলক মূল্যনীতির প্রভাব
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম ১৮৮ শতাংশ বাড়িয়েছে। গত ১৫ বছরে মোট ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে দেশের বিদ্যুৎ খাত ও উৎপাদন খাতের সব পণ্যের দাম বেড়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে, বিদ্যুতের অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির পেছনে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করেছেন, যা বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানির সঙ্গে করা বৈষম্যমূলক বিদ্যুৎ চুক্তি। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডকে (বিপিডিবি) অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর তুলনায় আদানি প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা এই বিদ্যুৎ চুক্তিটি বৈষম্যমূলক এবং প্রতারণামূলক। তাদের মতে, এই চুক্তির মাধ্যমে আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং বাড়তি মূল্য দাবি করেছে।
আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য বাংলাদেশকে কয়লার দাম হিসেবে ৮ টাকা ২২ পয়সা দিতে হয়, যেখানে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লার দাম ৬ টাকা ২২ পয়সা। এছাড়াও, আদানি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ও পরিচালন খরচ হিসেবে ৭ টাকার বেশি দাবি করছে। এই অতিরিক্ত খরচের কারণে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের খরচ বেড়েছে, যা সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
আদানির সঙ্গে করা এই বিদ্যুৎ চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে ২৫ বছরের মধ্যে অতিরিক্ত ১ লাখ কোটি টাকা দিতে হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আদানির চুক্তিতে উল্লেখিত বিভিন্ন শর্ত, যেমন কয়লার অপচয়, শুল্কসুবিধা প্রদর্শন না করা, এবং উৎপাদন সক্ষমতার কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনার বাধ্যবাধকতা, বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে। এর মাধ্যমে আদানি গ্রুপ দেশের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম মনে করেন, আদানি ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে এই চুক্তি করেছে এবং এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা করা হয়নি। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, এই চুক্তি বাতিল করে বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
বর্তমানে আদানির সঙ্গে করা বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে সরকার পুনর্বিবেচনা করছে। কাস্টমস গোয়েন্দা এবং তদন্ত অধিদপ্তর আদানি কেন্দ্রের শুল্ক-করের অনিয়ম খতিয়ে দেখছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইন স্থগিত রেখে এই চুক্তির কারিগরি এবং আর্থিক দিক বিশ্লেষণ করছে। ভারতের ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত আদানি গ্রুপের ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। এছাড়াও, আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ সরকার অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদানি চুক্তিতে প্রতারণার উপাদান রয়েছে এবং এই চুক্তি বাতিল হলে দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে। ভারত ইতোমধ্যে নিজ দেশে বিদ্যুৎ বিক্রির সুযোগ উন্মুক্ত করেছে, যার ফলে আদানি প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই চুক্তির ফলে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ পেয়েছে আদানি গ্রুপ। ফলে, বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও জানুন –শেখ পরিবারের নাম থাকলেই বিভিন্ন প্রকল্পের অনুমোদন পাস : ৮২ প্রকল্পে ব্যয় ৫১ হাজার কোটি টাকা
বিদ্যুৎ খাতের আরেকটি বড় সমস্যা হলো সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে উচ্চ খরচ। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং পাকিস্তান সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের দাম এখনও বেশি। ভারতে সম্প্রতি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হয়েছে ৩ সেন্ট, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ টাকা ৫৮ পয়সা। একইভাবে পাকিস্তানে সৌরবিদ্যুতের দাম কমিয়ে ৫ সেন্টের আশেপাশে আনা হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ টাকা ৮২ পয়সা।
কিন্তু বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় খরচ হচ্ছে ৯ থেকে ১০ সেন্ট, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০ টাকা ৭৫ পয়সা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি না হওয়া এবং সরকারি প্রণোদনার অভাবে এই খরচ এত বেশি। যদি এই খাতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায়, তাহলে সৌরবিদ্যুতের দাম অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
বিদ্যুৎ খাতে খরচ কমানোর জন্য সরকারকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রণোদনা দিতে হবে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতে প্রণোদনার পরিকল্পনা করছে, তবে এই পরিকল্পনার কার্যকারিতা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি সংস্থান, অবকাঠামো নির্মাণ, এবং সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমানো সম্ভব। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে জনগণের উপর চাপ কমানো সম্ভব হবে।
বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং চুক্তির বৈষম্যপূর্ণ শর্তাবলীর পেছনে দুর্নীতি এবং অনিয়ম প্রধান ভূমিকা পালন করছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিযোগিতাহীন বাজারের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কম। বিদ্যুৎ খাতের ঋণ ও দায়-দেনা মেটানোর নামে ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত খরচ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
বিদ্যুৎ খাতের এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশেষজ্ঞরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন। তারা মনে করেন, যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়, তবে ভোক্তাদের ওপর চাপ কমানো সম্ভব হবে এবং দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় উন্নতি আসবে।
বাংলাদেশের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আদানি চুক্তির মতো বৈষম্যমূলক ও প্রতারণামূলক চুক্তি, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে উচ্চ খরচ, এবং খাতের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব শুধু ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নতির জন্য সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কমাতে এবং জনগণের উপর থেকে চাপ কমাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং সরকারি প্রণোদনা ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। এতে করে বিদ্যুৎ খাতের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হবে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
Leave a Reply