আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ নিউজ :
WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
থ্যালাসেমিয়া রক্তের রোগ , এর প্রতিরোধ ও সঠিক চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া রক্তের রোগ , এর প্রতিরোধ ও সঠিক চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া রক্তের রোগ , এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়া রক্তের রোগ , এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া রক্তের রোগ , এর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া রক্তের রোগ । এটি একটি বংশগত রোগ , যা হিমোগ্লোবিনের অস্বাভাবিক উৎপাদন ঘটায় । ফলে এটি শরীরে রক্তশূন্যতা তৈরি করে। এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং আফ্রিকার কিছু অংশে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। বাংলাদেশেও থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং এর প্রতিরোধ ও সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে।

থ্যালাসেমিয়া কী?

থ্যালাসেমিয়া হল এমন একটি রোগ যা জিনগতভাবে পিতামাতা থেকে সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। হিমোগ্লোবিন হল লোহিত রক্তকণিকায় থাকা একটি প্রোটিন, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন বহন করে। থ্যালাসেমিয়া রোগে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে সুস্থ হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না, ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় না এবং রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।

থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ

থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই ধরনের হতে পারে—আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া। এছাড়াও থ্যালাসেমিয়া মাইনর এবং থ্যালাসেমিয়া মেজর নামে দুটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা দেখা যায়।

  1. আলফা থ্যালাসেমিয়া: এই ধরনের থ্যালাসেমিয়ায় শরীরে আলফা গ্লোবিন প্রোটিন তৈরি কম হয়। আলফা গ্লোবিন তৈরি করার জন্য চারটি জিন প্রয়োজন। এর মধ্যে যদি এক বা একাধিক জিনে সমস্যা হয় তবে আলফা থ্যালাসেমিয়া দেখা দিতে পারে।
  2. বিটা থ্যালাসেমিয়া: বিটা থ্যালাসেমিয়া হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরে বিটা গ্লোবিন প্রোটিন তৈরি কম হয়। এতে বিটা গ্লোবিন তৈরির দায়ী দুটি জিনে সমস্যা থাকে।
  3. থ্যালাসেমিয়া মাইনর: এটি একটি কম গুরুতর রূপ, যেখানে রোগটি হালকা রক্তশূন্যতার আকারে দেখা যায়। থ্যালাসেমিয়া মাইনর রোগীরা সাধারণত কোনো গুরুতর উপসর্গ অনুভব করেন না এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।
  4. থ্যালাসেমিয়া মেজর: থ্যালাসেমিয়া মেজর একটি গুরুতর অবস্থা, যা জন্মের কিছু বছর পর থেকে লক্ষণ প্রকাশ পায়। এই অবস্থায় শিশুরা চরম রক্তশূন্যতায় ভুগে থাকে এবং নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ ও উপসর্গ

থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ রোগের ধরন এবং তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। থ্যালাসেমিয়া মাইনর রোগীদের ক্ষেত্রে উপসর্গ খুব কম বা একেবারে থাকে না। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো বেশ প্রকট হতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

  • চরম রক্তশূন্যতা
  • ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
  • ক্লান্তি ও দুর্বলতা
  • হাড়ের বিকৃতি
  • বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া
  • ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের সমস্যাগুলো
  • বর্ধিত লিভার ও স্প্লিন
  • বারবার ইনফেকশন হওয়া

থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের পদ্ধতি

থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে কিছু সাধারণ পরীক্ষা হলো:

  • সম্পূর্ণ রক্ত পরীক্ষার (CBC) মাধ্যমে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা এবং রক্তকণিকার আকার পরীক্ষা করা হয়।
  • হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস: এটি হিমোগ্লোবিনের ধরণ নির্ণয়ের একটি প্রক্রিয়া, যা থ্যালাসেমিয়ার উপস্থিতি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
  • ডিএনএ টেস্ট: এই পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার জন্য দায়ী জিনগত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যায়।

আরও জানুন –ডিমেনশিয়া: ভুলে যাওয়ার রোগ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, এবং একে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব নয়। তবে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রোগীদের জীবনের মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।

  1. নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন: থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীদের নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। এটি রক্তশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে এবং রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করে।
  2. লোহা অপসারণ (Iron Chelation Therapy): থ্যালাসেমিয়ায় নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের ফলে শরীরে অতিরিক্ত লোহা জমা হয়, যা লিভার ও হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। লোহা অপসারণের জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা শরীর থেকে অতিরিক্ত লোহা বের করে দিতে সাহায্য করে।
  3. বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (Bone Marrow Transplant): এটি থ্যালাসেমিয়ার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যা রোগকে পুরোপুরি নিরাময় করতে পারে। তবে এই পদ্ধতি বেশ জটিল এবং খরচবহুল, পাশাপাশি উপযুক্ত ডোনার পাওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
  4. জিন থেরাপি (Gene Therapy): থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি নতুন সম্ভাবনা হল জিন থেরাপি। এই থেরাপির মাধ্যমে আক্রান্ত জিনগুলোকে প্রতিস্থাপন করে সুস্থ জিন স্থাপন করা হয়। যদিও এই পদ্ধতি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে, তবে এটি ভবিষ্যতে থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।

থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধ

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ হওয়ায় এটি পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করে এর ঝুঁকি হ্রাস করা যায়।

  1. জেনেটিক কাউন্সেলিং: যেসব দম্পতির থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা থ্যালাসেমিয়া রোগের ইতিহাস রয়েছে, তাদের সন্তান ধারণের আগে জেনেটিক কাউন্সেলিং করানো উচিত। এটি তাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত করে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে।
  2. প্রি-নাটাল টেস্টিং: গর্ভাবস্থায় প্রি-নাটাল টেস্টিংয়ের মাধ্যমে শিশুর থ্যালাসেমিয়া ঝুঁকি নির্ণয় করা যায়। এটি সময়মতো ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করে।
  3. বিবাহপূর্ব রক্ত পরীক্ষা: থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য বিবাহপূর্ব রক্ত পরীক্ষা অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। দুইজন থ্যালাসেমিয়া বাহক একসঙ্গে বিয়ে করলে তাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া মেজর হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই বিবাহের আগে রক্ত পরীক্ষা করে এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার প্রভাব

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতি বছর অসংখ্য শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে, এবং তাদের চিকিৎসার জন্য পরিবারগুলিকে ব্যাপক আর্থিক ও মানসিক চাপের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর প্রতিরোধ ও সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে অজ্ঞতা , সচেতনতার অভাব এবং সেই সাথে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার অভাবেও অনেক রোগী সঠিক সময়ে চিকিৎসা পায় না, ফলে তাদের জীবনের মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট হাসপাতাল ও সংস্থা কাজ করছে, তবে এর পরিমাণ যথেষ্ট নয়। দেশব্যাপী আরও বেশি থ্যালাসেমিয়া সেন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন এবং রোগীদের জন্য চিকিৎসা সুবিধা সহজলভ্য করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা

থ্যালাসেমিয়ার প্রভাব কমানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এর প্রতিরোধ ও সঠিক চিকিৎসা এবং সঠিক সচেতনতা। থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে মানুষকে আরও বেশি সচেতন করা এবং জেনেটিক পরীক্ষা ও কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্ব বোঝানো অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রিত হয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সাহায্য করার জন্য কাজ করতে হবে।

থ্যালাসেমিয়া এবং জীবনযাপন

থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে দীর্ঘ জীবনযাপন করতে পারে। এর প্রতিরোধ ও সঠিক চিকিৎসা , পরামর্শ এবং জীবনযাপনের পরিবর্তন তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।

থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর রক্তজনিত রোগ হলেও এর প্রতিরোধ ও সঠিক চিকিৎসা এবং সচেতনতামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে এর প্রভাব অনেকটাই কমানো সম্ভব। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ এবং রোগীদের জীবনমান উন্নত করতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং সরকারকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

পোষ্ট টি শেয়ার করে দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024 desherbulletin.Com
Developed By One Planet Web