আজ মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩১ পূর্বাহ্ন
নির্বাচন কমিশন এবার নেমেছে ইভিএমে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সম্ভাবনা আপাতত না থাকলেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখন সচল ইভিএম ও অন্যান্য নির্বাচনি সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য ইভিএমে নতুন পরিকল্পনা করছে। এই প্রকল্পের মধ্যে ইভিএমের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ভবিষ্যতে প্রযুক্তির সুষ্ঠু প্রয়োগের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর, নির্বাচন কমিশন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি সংস্কার পরিকল্পনা জমা দেয়। সেখানে নির্বাচনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ভোট গ্রহণ, ফলাফল প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যারসহ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহারের পরিকল্পনা ইসির অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ইভিএমসহ অন্যান্য নির্বাচনি সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য ১০টি অঞ্চলে ওয়্যারহাউস নির্মাণ।
ইসির মতে, আগামী বছরের ১ অক্টোবরের মধ্যে এই ওয়্যারহাউস নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। এসব ওয়্যারহাউস নির্মাণের উদ্দেশ্য ইভিএমসহ সমস্ত নির্বাচনি সামগ্রী সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা, যাতে ভবিষ্যৎ নির্বাচনের সময় কোনো সমস্যা না হয়।
ইসি ইতিমধ্যেই ১০টি অঞ্চলে ওয়্যারহাউস নির্মাণের জন্য জমি খুঁজছে। এজন্য বিভাগীয় কমিশনার এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রথম ওয়্যারহাউস নির্মাণের কাজ শুরু হবে ঢাকা অঞ্চলে, বিশেষ করে মিরপুরের ইসিবি চত্বর এলাকায়। সেখানে ৫৭ শতাংশ খাস জমি বরাদ্দের জন্য ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। ইসির একটি টিম জমি পরিদর্শনও করেছে এবং দ্রুত কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এছাড়াও, রংপুর, রাজশাহী, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলেও জমি খোঁজার প্রক্রিয়া চলছে। নির্বাচন কমিশন মনে করে, এই ওয়্যারহাউসগুলো ইভিএম ও অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ইসির সচিব শফিউল আজিম জানান, নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন সামগ্রী সংরক্ষণ নিয়ে ইসিকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক সময় উচ্চ মূল্যে জায়গা ভাড়া করতে হয়। শুধু ইভিএম নয়, অন্যান্য নির্বাচনি সামগ্রীও স্কুল, কলেজ, বা অডিটরিয়ামে সংরক্ষণ করতে হয়, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তাই ইভিএমে নতুন পরিকল্পনা , ইসির নিজস্ব ওয়্যারহাউস নির্মাণের পরিকল্পনা এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সহায়ক হবে।
ইসির এক সভায় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে অনেক ইভিএমই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কিছু মেশিন পরীক্ষার পর দেখা গেছে, এগুলো আর মেরামত করার উপযুক্ত নয় এবং সেগুলো বিনষ্ট করা প্রয়োজন। এই কারণে ইসির কর্মকর্তারা ১০টি অঞ্চলে ওয়্যারহাউস নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন। এর জন্য ওয়্যারহাউসের একটি খসড়া ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে, যা মাঠপর্যায়ে প্রেরণ করা হবে। পাশাপাশি, জমি ও অন্যান্য খরচের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হবে। তাই ইসি ইভিএমে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে জোর দিয়েছেন ।
ইভিএমের ব্যবহার শুরু হয় ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের আমলে। সেই সময় বুয়েট থেকে মেশিন তৈরি করা হয়েছিল, যার প্রতিটির দাম ছিল ১২ হাজার টাকা। পরবর্তীতে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশনও ইভিএম ব্যবহার করে, কিন্তু ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে মেশিনের অকার্যকারিতা দেখা দিলে, তা আর মেরামত করা সম্ভব হয়নি। তখন সেই ইভিএমগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং উন্নত মানের ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
২০১৭ সালে, কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ইভিএমের জন্য উচ্চমূল্যের মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করা হয়, যার প্রতিটি মেশিনের ব্যয় ছিল প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। সে সময় প্রায় দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয় এবং এই প্রকল্পের বাজেট ছিল ৩,৮২৫ কোটি টাকা।
বর্তমানে ইসির হাতে থাকা ইভিএমের প্রায় ৪০ হাজার মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অবশিষ্ট মেশিনগুলোরও অনেকগুলোতে ত্রুটি ধরা পড়েছে। কিন্তু মেরামতের জন্য নতুন কোনো অর্থ বরাদ্দ না থাকায়, ইসির মেশিনগুলো অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। ইভিএম মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য ইসি সাড়ে ১২ শ কোটি টাকার প্রস্তাব দিলেও, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সরকার তা নাকচ করে দেয়। এর ফলে বর্তমানে অচল ইভিএমের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
বিগত কমিশনের সময়, ইসি নতুন ব্যয় না বাড়িয়ে অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে প্রকল্প চালানোর অনুমতি চায়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে মৌখিক সম্মতি দেওয়া হলেও, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ইসি সচিবালয় থেকে বারবার যোগাযোগ করা হলেও প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
ইভিএম প্রকল্পের বর্তমান অবস্থান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নির্বাচন কমিশন চিন্তিত। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সম্ভাবনা কম থাকলেও, সচল ইভিএম এবং অন্যান্য নির্বাচনি সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য ইসি নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। একই সঙ্গে, নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং ইভিএমসহ নির্বাচনি সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউস নির্মাণের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে ইভিএমের বর্তমান সমস্যা এবং মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায়, ইভিএমে নতুন পরিকল্পনা প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে।
Leave a Reply