আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৫ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে দেশের ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কিছু ধনকুবের ও ব্যবসায়ীরা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সহায়তায় এই বিশাল অর্থ পাচার করেছেন। গভর্নর মনসুর বলেন, ডিজিএফআইয়ের সমর্থন নিয়ে বিভিন্ন শক্তিশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা দেশের ব্যাংকগুলো দখল করে আসছিল। তার মতে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এটি একটি বড় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা, যা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত হয়েছে।
গভর্নর মনসুরের এই বক্তব্য দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্ববহ। তিনি ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা ও অবৈধ অর্থ পাচারের বিষয়ে সরাসরি বক্তব্য প্রদান করেন, যা সচরাচর বাংলাদেশে শোনা যায় না। তার ভাষ্যমতে, এই পাচারের অর্থের পরিমাণ বর্তমান অর্থবছরের বাজেটের ২৫ শতাংশের সমান, যা দেশের আর্থিক নিরাপত্তা ও ব্যাংকিং সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
ড. মনসুর উল্লেখ করেন, প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ অর্থ দুবাই, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য স্থানে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বর্তমান সরকার এই অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে।
গভর্নরের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্যাংক থেকে অর্থ পাচারের জন্য কয়েকটি নির্দিষ্ট কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিগুলো হলো:
এই অর্থ পাচারের ফলে দেশের ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। মূলত, ব্যাংকগুলোয় থাকা জমাকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু এই ধরনের ঘটনার কারণে সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাংকিং সেবার প্রতি আস্থা কমে যেতে পারে।
আরও জানুন –আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন
গভর্নর মনসুরের ভাষ্যমতে, এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং তার সহযোগীরা ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যাংক থেকে বের করে নিয়ে গেছেন। এস আলম গ্রুপের পক্ষে একটি আইনি প্রতিষ্ঠান বিবৃতি দিয়ে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এস আলম গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই গ্রুপ ব্যাংকিং খাতেও প্রবেশ করেছে এবং ইতিমধ্যেই তারা বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অংশীদার। তাদের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ সাতটি ব্যাংকে তাদের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে।
এই বিশাল পরিমাণ অর্থ পাচারের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে, বাজেটের তুলনায় এই পরিমাণ অর্থ অত্যন্ত বড়। এর প্রভাব ইতোমধ্যে দেশের মুদ্রা বাজার, বিনিয়োগ এবং আর্থিক খাতের ওপর পড়তে শুরু করেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই অর্থ উদ্ধার করা এবং পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এই অর্থ পাচারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে কিছু নীতিমালা গ্রহণ করা যেতে পারে:
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এই রিপোর্ট আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের এমন দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
গভর্নর মনসুর জানান, পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কাজ করে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
ড. মনসুর দেশের ব্যাংকগুলোর শেয়ার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রির পরিকল্পনা করছেন, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে পুনরায় স্থিতিশীল করতে পারে। পাশাপাশি খারাপ হয়ে পড়া সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করার পরিকল্পনা করছে।
দেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সুশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন এবং স্বচ্ছতার অভাবে অর্থ পাচার ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
ড. আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্য এবং ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের রিপোর্ট দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান চিত্র এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জকে সামনে তুলে ধরেছে। এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত, কঠোর শাস্তি প্রদান এবং অর্থ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতকে পুনরায় স্থিতিশীল করার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এই বিশাল অর্থ পাচারের ঘটনায় বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনার পর নতুন করে আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং ব্যাংক খাতের সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যেতে হবে, যাতে করে দেশের অর্থনীতি সুসংহত এবং স্থিতিশীল থাকতে পারে।
Leave a Reply