আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৫ অপরাহ্ন
নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—তারা কি ন্যায়বিচার পাবেন? গত ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান‘ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে কোন মামলা বা গ্রেপ্তারের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা এই প্রশ্নটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে, যেসব পুলিশ সদস্য আন্দোলনের সময় প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের দাবি এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
গত জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছাত্র-জনতা এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় পুলিশের ৪৪ জন সদস্য প্রাণ হারান। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানায় হামলা ও চার পুলিশ সদস্যের হত্যার ঘটনা ছিল এই সংঘর্ষের একটি ভয়াবহ উদাহরণ। এই হামলায় কনস্টেবল আব্দুল মজিদসহ চারজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং থানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কনস্টেবল মজিদের স্ত্রী শাহজাদী বেগম একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন, তবে এখন পর্যন্ত মামলার তদন্ত শুরু হয়নি।
পুলিশ সদস্যদের স্বজনরা এমন এক অবস্থার মধ্যে আছেন যেখানে তারা শুধু প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন না, বরং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও তারা উপেক্ষিত বলে মনে করছেন। শাহজাদী বেগমের বক্তব্য অনুযায়ী, তার সাথে এখনো কেউ যোগাযোগ করেনি, সান্ত্বনা দেওয়া দূরে থাক। এমনকি, তিনি দাবি করেছেন যে, আন্দোলনে নিহত ছাত্র-জনতার জন্য যেভাবে সুবিধা এবং প্রচার হচ্ছে, তেমনটা পুলিশ সদস্যদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, “আমার স্বামী আন্দোলনে কোন ডিউটি করেনি, তিনি থানাতেই ছিলেন। তার হত্যা করার পর আমাদের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।”
আরও জানুন –শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করা সাংবাদিকদের এখন কী হবে ?
যাত্রাবাড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, “এই মামলার তদন্ত চলছে, তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।” যদিও ৫ আগস্টের আগে ঘটে যাওয়া দুটি পুলিশ হত্যার মামলায়ও একইভাবে তদন্ত চলছে, তবে কোনো আসামীকে ধরা সম্ভব হয়নি। এ থেকে স্পষ্ট যে, নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের জন্য বিচার পাওয়া যেন দিন দিন আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানায় পুলিশের উপর হামলা এবং হত্যার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও, তদন্তের অবস্থা নিয়ে জনগণের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেছেন, “গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন নাইম হোসেন, যিনি পুলিশের অস্ত্র লুটের ঘটনায় জড়িত ছিলেন।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে যে, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় কোনো মামলা বা গ্রেপ্তার করা হবে না। তবে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বলেন, “বিজ্ঞপ্তিটি হত্যা মামলার জন্য নয়, বরং আন্দোলনে জড়িত সাধারণ জনগণের হয়রানি রোধের উদ্দেশ্যে।” এর মানে হলো, পুলিশ হত্যা বা থানায় হামলার ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, এসব ঘটনার বিচার প্রাপ্তি এবং দায়মুক্তির প্রসঙ্গ জনগণের মধ্যে সংশয় তৈরি করেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ২০ জুলাই থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে পুলিশের ৪৪ জন সদস্য মারা গেছেন। এর মধ্যে ৫ আগস্ট তারিখেই সর্বাধিক ২৫ জন সদস্য নিহত হন। এসব হত্যার ঘটনাগুলোতে বিভিন্ন থানায় মামলা দায়ের হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখনো তদন্তের কাজ চলমান আছে এবং অপরাধীরা ধরা পড়েনি।
এনায়েতপুর থানায় ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এই থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাকসহ ১৫ জন পুলিশ সদস্যের হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। রাজ্জাকের বোন মাউনজেরা খাতুন জানিয়েছেন, তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে পরিবারে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, এমনকি পোস্টমর্টেম রিপোর্টও তারা পাননি।
নোয়াখালীতে পুলিশের উপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ গ্রেপ্তারকে সঠিক বলে মনে করছেন, আবার কেউ বলছেন, এটি অন্যায়ভাবে করা হয়েছে। বিশেষ করে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুকে জানিয়েছেন যে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক বা নিয়মিত সদস্য ছিলেন না, বরং তারা স্থানীয় একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে, পুলিশ বাহিনীতে নতুন করে সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ৬৪ জেলা থেকে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে ৪২০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এছাড়াও, এসআই পদেও নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
নতুন সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া যেখানে চলছে, সেখানে পুরনো সদস্যদের হত্যার বিচার না পাওয়া পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস করতে পারে। বিশেষত, নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
নিহত পুলিশ সদস্যের পরিবারগুলো বর্তমানে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়ার ধীর গতি এবং সরকারের উদাসীনতা তাদের কষ্টকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই প্রেক্ষাপটে, নিহতদের পরিবারগুলোর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহায়তার গুরুত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্রের উচিত দ্রুত তদন্তের কাজ সমাধান করে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের পুনর্বাসনের যথাযথ ব্যবস্থা করা।
Leave a Reply