আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৩২ অপরাহ্ন
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোকেমিক্যাল খাতের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশেষত, ইরানের তেল পরিবহনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্য করে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবরের ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়ায় এই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাইডেন প্রশাসন। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় (ইউএস ট্রেজারি) এবং পররাষ্ট্র দফতর (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) যৌথভাবে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং ইরানের তেল রপ্তানি ব্যবস্থার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে মূলত ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়ে। ইসরায়েল পূর্বে জানিয়েছে যে, তারা ইরানের হামলার প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত। মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, “এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইরানের জ্বালানি তেল আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে অবৈধভাবে পৌঁছে দেওয়া ভৌতিক জাহাজবহর (Ghost Fleet) বন্ধ করা সম্ভব হবে।”
সুলিভান আরও উল্লেখ করেন যে, এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এমন কোনও সন্ত্রাসী সংগঠনকেও ইরান আর সমর্থন দিতে পারবে না।
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইসরায়েলকে নতুন এক ধরনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। ইসরায়েল জানিয়েছে যে, তারা লেবানন ও গাজায় তাদের আক্রমণ বৃদ্ধি করেছে এবং তারা ইরানের মাটিতেও হামাস নেতাকে হত্যার জন্য হামলা চালিয়েছে। ইরান এই হামলাকে ‘সমুচিত জবাব’ হিসাবে দেখছে এবং ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোকেমিক্যাল খাতের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে মূলত ইরানের অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ইউএস ট্রেজারির মতে, এই খাত ইরানের রাজস্বের একটি প্রধান উৎস এবং এটি ইরানের সামরিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির অর্থায়নেও ভূমিকা রাখে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৬টি প্রতিষ্ঠান এবং ১৭টি জাহাজকে নিষিদ্ধ করেছে যারা ইরানের তেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি এবং তাদের বিভিন্ন আঞ্চলিক সহযোগীদের ওপরও কার্যকর হবে।
ইরানের ওপর আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বৈশ্বিক তেল সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে চীন, যারা ইরানের অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। বর্তমানে ইরানের তেলের প্রায় ৯০ শতাংশ চীন কিনে থাকে, এবং নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে কার্যকর হলে চীনা কোম্পানিগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে।
চীন ছাড়াও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপরও মার্কিন প্রশাসন চাপ প্রয়োগ করতে পারে, কারণ এই দেশগুলোর তেলের বাণিজ্যে ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে গেলে তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে।
আরও জানুন –ইসরায়েলকে ‘ফ্যাসিস্ট’ ও ‘গণহত্যাকারী’ হিসেবে ঘোষণা দিল নিকারাগুয়া
চীন ইরানের অপরিশোধিত তেলের প্রধান ক্রেতা হয়ে ওঠায় ইরান নিষেধাজ্ঞার পরও নিজের তেল রপ্তানি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরানের তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তবে চীন এবং কিছু এশিয়ান দেশ এই নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে ইরান থেকে তেল কিনতে থাকে।
চীনা বাজারে ইরানের তেল বিক্রি ইরানের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন হয়ে উঠেছে। তবে মার্কিন প্রশাসনের নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে, ইরানের অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়তে পারে। কারণ চীনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং তাদের ওপর সরাসরি চাপ প্রয়োগ করলে ইরানের তেল রপ্তানি জটিল হয়ে উঠতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে ঘিরে নিজস্ব অবস্থান গ্রহণ করেছে। উপসাগরীয় দেশগুলো বিশেষত ইরানের সঙ্গে তেলক্ষেত্রে সংঘাত এড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, ইরানের তেলক্ষেত্রে ইসরায়েলের আক্রমণ হলে সংঘাতের মাত্রা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে এবং তারাও তেহরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণের শিকার হতে পারে।
ইরান ইসরায়েলের তেলক্ষেত্রে আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে চাইছে, কিন্তু তাদের সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ ইসরায়েলকে একাধিকবার প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করেছে। ইরানের মিত্র হিসেবে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোকেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়াতে পারে। বিশেষ করে লেবানন এবং সিরিয়ার মাধ্যমে এই ধরনের সংঘাতের ঝুঁকি বেশি।
ইরানের সামরিক বাহিনী এবং তার সহযোগী মিলিশিয়া গোষ্ঠী এই সংঘাতকে আরও বিস্তৃত করতে পারে যা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক তেল সরবরাহের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে।
এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইরানের তেলখাত ও জ্বালানি শিল্প চাপে পড়বে। ইরানের তেলের রপ্তানি নিষিদ্ধ হলে ইরানের রাজস্ব সংকট আরও তীব্র হবে এবং তাদের সামরিক সক্ষমতা হ্রাস পাবে। তবে চীন ও অন্যান্য দেশ ইরানকে তেল বিক্রির সুযোগ দিয়ে নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের ভূরাজনৈতিক প্রভাব কমানোর লক্ষ্য নিয়ে চালানো হয়েছে। ইরানের তেল রপ্তানির ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থনৈতিক সংকটকে তীব্র করতে চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের পেট্রোলিয়াম এবং পেট্রোকেমিক্যাল খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে নতুন ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিকে নতুন এক সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের জ্বালানি শিল্প এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় ধরনের আঘাত হয়ে দাঁড়াবে। তবে চীন এবং অন্যান্য দেশ ইরানের পক্ষে অবস্থান নিলে এই নিষেধাজ্ঞার বাস্তব প্রভাব কিছুটা প্রশমিত হতে পারে।
Leave a Reply