আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন
স্থূলতা (Obesity) বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ সমস্যাটি দ্রুত বাড়ছে, যা শুধু ব্যক্তির স্বাস্থ্যই নয় বরং অর্থনীতি, সমাজ এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপরও বিরাট চাপ সৃষ্টি করছে। এটি শুধু সৌন্দর্য বা শারীরিক আকারের প্রশ্ন নয়; এটি এমন একটি সমস্যা, যা সরাসরি মানবজীবনের গুণগত মানকে প্রভাবিত করে এবং হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
এই প্রতিবেদনে আমরা স্থূলতার কারণ, প্রভাব এবং এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। পাশাপাশি, কীভাবে এটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে এবং কীভাবে আমরা এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেতে পারি, তা তুলে ধরবো।
স্থূলতা বলতে বোঝায় শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া, যা ব্যক্তির স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সাধারণত, স্থূলতা পরিমাপের জন্য বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ব্যবহৃত হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য BMI যদি ২৫ থেকে ২৯.৯ হয়, তবে তাকে অতিরিক্ত ওজনধারী (overweight) হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং যদি তার BMI ৩০ এর বেশি হয়, তবে তাকে স্থূল বলা হয়।
BMI = ওজন (কেজি) / উচ্চতা² (মিটার)।
যদিও BMI সাধারণত স্থূলতা পরিমাপের একটি সহজ উপায়, তবে এটি ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত অবস্থা এবং শরীরের চর্বির প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা সবচেয়ে ভালো উপায়।
স্থূলতার কারণ বিভিন্ন হতে পারে এবং প্রায়শই একাধিক কারণ একসাথে কাজ করে। নিম্নে স্থূলতার প্রধান কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো:
বেশিরভাগ সময় স্থূলতার প্রধান কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। উচ্চ ক্যালোরি, চর্বি এবং চিনিযুক্ত খাবার, বিশেষ করে ফাস্ট ফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার, স্থূলতার অন্যতম প্রধান কারণ। প্রায়শই এই ধরনের খাবার গ্রহণ শরীরে অতিরিক্ত ক্যালোরি জমা করে যা চর্বিতে পরিণত হয়।
শারীরিক ক্রিয়াকলাপের অভাব বা অলস জীবনধারা স্থূলতার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যারা সারা দিন বসে কাজ করেন এবং খুব কম শারীরিক পরিশ্রম করেন, তারা বেশি মাত্রায় ওজন বাড়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
অনেক ক্ষেত্রে স্থূলতার পেছনে জেনেটিক কারণও থাকতে পারে। পারিবারিক ইতিহাসে স্থূলতা থাকলে, ব্যক্তির স্থূল হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কিছু জেনেটিক বৈশিষ্ট্য মানুষের শরীরে চর্বি জমা এবং তা পরিচালনার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, যেমন থাইরয়েডের সমস্যা, ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা বা মেটাবলিজমের বিকৃতি, অনেক সময় স্থূলতার কারণ হতে পারে। এই সমস্যাগুলোর কারণে শরীর সঠিকভাবে ক্যালোরি পোড়াতে পারে না এবং অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়।
মানসিক অবস্থা এবং চাপের প্রভাবেও স্থূলতা বাড়তে পারে। অনেক মানুষ মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতার সময় অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করেন, যা ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
আরো পড়ুন- ব্যক্তির মেজাজ, শক্তি এবং কার্যক্রমে অস্বাভাবিক পরিবর্তনই বাইপোলার ডিসঅর্ডার
স্থূলতা কেবল শারীরিক আকারকে প্রভাবিত করে না; এটি বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত জটিলতা সৃষ্টি করে যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয়। নিম্নে স্থূলতার কিছু প্রধান প্রভাব উল্লেখ করা হলো:
স্থূলতা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হলে এটি রক্তনালীতে চর্বি জমাতে পারে, যা রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে।
স্থূল ব্যক্তিদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, যা ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ।
স্থূলতা শরীরের হাড় এবং অস্থিসন্ধির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা আর্থ্রাইটিস বা হাঁটুর জয়েন্টের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
স্থূলতার সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। স্থূল ব্যক্তিরা প্রায়শই আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন এবং বিষণ্ণতা, উদ্বেগ বা সোশ্যাল ফোবিয়ার শিকার হতে পারেন। এছাড়াও, সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
স্থূলতা ঘুমের সমস্যা, বিশেষ করে স্লিপ অ্যাপনিয়া (sleep apnea) সৃষ্টি করতে পারে। এই রোগে ঘুমের সময় শ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়, যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়।
স্থূলতা মোকাবেলা করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী এবং স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হবে জীবনযাত্রায় এবং খাদ্যাভ্যাসে। কয়েকটি কার্যকরী উপায় নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
স্থূলতা মোকাবেলার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো সুষম এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা। উচ্চ চর্বি এবং চিনিযুক্ত খাবার পরিহার করে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, ফল এবং আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। প্রতিদিনের ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং হালকা স্ন্যাকসের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ওজন কমাতে সহায়ক হতে পারে।
প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার অন্যতম কার্যকর উপায়। হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা বা যোগব্যায়ামের মতো শারীরিক ক্রিয়াকলাপগুলো ক্যালোরি পোড়াতে এবং চর্বি কমাতে সাহায্য করে। একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের শারীরিক ক্রিয়াকলাপের পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপকে স্বাভাবিক রাখে এবং খাবার হজম করতে সহায়ক হয়। এছাড়া, খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি পান করলে ক্ষুধা কমে এবং খাবার কম খাওয়া হয়।
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নিয়মিত যোগব্যায়াম, মেডিটেশন এবং চাপ কমানোর বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতাও কমে যাবে।
প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কম ঘুম শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে, যা ক্ষুধা বাড়াতে এবং অতিরিক্ত খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করে।
স্থূলতা বৈশ্বিক সমস্যা হওয়ায় অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশীয় সরকার এই সমস্যা মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হলো:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং পুষ্টি শিক্ষার মাধ্যমে স্থূলতা প্রতিরোধে প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জনগণকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ এবং কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
স্থূলতা প্রতিরোধে অনেক দেশ শারীরিক কার্যকলাপ বাড়াতে জনগণকে উৎসাহিত করছে। যেমন, ফুটবল, সাইকেল চালানো এবং অন্যান্য আউটডোর ক্রিয়াকলাপকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
পুষ্টি শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য নির্বাচন এবং সঠিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।
Leave a Reply