আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২০ পূর্বাহ্ন
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর পর্যালোচনা অতি জরুরি একটি ইস্যু হয়ে উঠেছে। মূলত যারা শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে, তারা এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের দ্বারা লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছেন। অধিকার কর্মীরা এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, এবং তাদের মতে, অনেক মামলার কোনো ভিত্তি নেই। এছাড়া, এসব মামলা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এসব আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ বিষয়ে বিশদ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘোষণা করেছিল যে তারা দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে যারা শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, “যারা জনমত গঠনের মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করেছেন, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবে।”
সরকারের আরেক উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ বলেন, “যদি তদন্তে দেখা যায় যে সাংবাদিকরা কোনো অপরাধে জড়িত নয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হবে।” এছাড়াও, তিনি বলেন যে মামলা সাধারণ জনগণ দায়ের করেছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। যদি মামলা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়, তাহলে অভিযুক্তরা আদালতে আবেদন করতে পারবে।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও নিশ্চিত করেন যে, সরকার সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না।
সার্বিকভাবে, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষা এবং নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক। মামলাগুলোর সঠিক তদন্ত ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সরকারের সদিচ্ছার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার কথা বললেও, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো এই প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেমন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (CPJ) এবং রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (RSF) এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এসব মামলা স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে। বিশেষত, ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হলে তা সাংবাদিকদের উপর মানসিক চাপ এবং পেশাগত স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করতে পারে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, যে মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে তা সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, এবং এর সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু অধিকাংশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, রাজনৈতিক কারণেই এসব মামলা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মামলাগুলো শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ নয়, বরং এগুলো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্যও হুমকি স্বরূপ। কারণ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের পদক্ষেপ ভবিষ্যতে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
আরও জানুন –সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে
অধিকার কর্মী ও সাংবাদিকরা বলছেন, মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এগুলো গণমাধ্যমের ভূমিকা ক্ষুণ্ন করার একটি কৌশল হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সাংবাদিক ফাহমিদা আক্তার বলেছেন, “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা হওয়া উচিত, কিন্তু ক্রোধের বশবর্তী হয়ে করা মামলা গ্রহণ করা ঠিক নয়।” এ ধরনের মামলা করার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের যে ভূমিকা রয়েছে, অর্থাৎ গণমাধ্যমের ‘পাহারা দেওয়া’ ভূমিকা, তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
মানবাধিকার কর্মী জেডআই খান পান্না বলেছেন, “সরকার যেহেতু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নেবে।” একইভাবে, আইনজীবী আইনুন্নাহার সিদ্দিকা লিপি বলেছেন যে, “এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয় যে সাংবাদিকদের ন্যায়সঙ্গতভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে কিনা, কারণ তদন্ত এখনও চলছে।”
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি তদন্ত সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় এবং ভিত্তিহীন মামলাগুলো অব্যাহত থাকে, তবে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে, গণমাধ্যমের ওপর চলমান চাপ কিছুটা কমানো সম্ভব হবে। এটি শুধুমাত্র সাংবাদিকদের নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সাংবাদিকদের ওপর মামলা করার ঘটনাটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সুশাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের মামলাগুলো শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জন্য উদ্বেগের কারণ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের উচিত দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
Leave a Reply