আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০২ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রাণপণে সংগ্রাম করে যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং অত্যাচার ও দমন-পীড়নের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের ভূমিকা ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অপকর্মের প্রতিবাদ জানানো অসংখ্য ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবার ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকেই বাড়িছাড়া ও দেশছাড়া হতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের সাহসিকতা ও দেশপ্রেম অনেকের কাছে প্রেরণার উৎস। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করবো তাদের কথা যারা আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারের রোষানলে পড়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে গেছেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশে একটি দমনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা বিরোধী মতামত ও সমালোচনার প্রতি ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এই সময়ে সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় অনেক সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, মানবাধিকারকর্মী ও স্বাধীন চিন্তাবিদকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী, পিনাকী ভট্টাচার্য, তাসনীম খলিল, ড. কনক সারোয়ার, জুলকারনাইন সায়ের খান সামি, ইলিয়াস হোসেনসহ আরও অনেকে।
তাঁরা দেশান্তরী হয়েও দেশের মানুষ ও গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য বিশ্ববাসীর সামনে আওয়ামী লীগের শাসনকালে সরকারের অত্যাচারের নানা চিত্র তুলে ধরেছেন। এ কাজে তাঁদের সাহসিকতা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করে সাহসিকতার সাথে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর সংবাদ ও ভিডিও বক্তব্য দেশবাসীর মধ্যে সরকারের দুর্নীতি ও অপশাসনের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ায়। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিলেও এখনো দেশে ফিরতে পারেননি তিনি, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি।
ফ্রান্সপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁর ক্ষুরধার বক্তব্যের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সমর্থন অর্জন করেন। তাঁর অনলাইন ভিডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলোর মাধ্যমে জনগণকে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পিনাকীর পরিবারকেও দেশে চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। তাঁর মা এবং মামাকে দেশের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়।
সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনীম খলিল সরকারের নানা দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তুলে ধরেছেন। নেত্র নিউজ থেকে গুম, ক্রসফায়ারের মতো ঘটনাগুলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাসনীম বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ সরকারের দমননীতি সম্পর্কে সবার নজর কাড়েন। তাঁর মাকেও ভীতি প্রদর্শন করা হয়।
সাংবাদিক ড. কনক সারোয়ার তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম তুলে ধরেছেন। এ কারণে তাঁর পরিবারও হয়রানির শিকার হয়। দেশ ছাড়ার আগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাঁকে নয় মাস জেল খাটতে হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ড. সারোয়ার সোচ্চার থেকেছেন এবং সরকারবিরোধী বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন।
আলজাজিরার অনুসন্ধানী রিপোর্টে জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং তাঁর পরিবারের দুর্নীতির বিষয় প্রকাশের মাধ্যমে জুলকারনাইন সায়ের খান সামি আলোচনায় আসেন। এরপর তিনি সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা সরকারকে বিপদে ফেলেছে।
আরো পড়ুন– জুলাই মাসের গণহত্যার ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে: ভলকার তুর্ক
সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন সামাজিক মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। দেশ ছাড়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে আরও মামলা দায়ের করা হয়। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ইলিয়াস বিভিন্ন গোপন তথ্যও প্রকাশ করেছেন।
দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া মনির হায়দার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ে সেমিনার পরিচালনা করেন। তিনি আওয়ামী লীগের শাসনামলে গৃহীত বিভিন্ন অপশাসনের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর পরিবারকেও দেশে হামলার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
বিজ্ঞানী ফাহাম আবদুস সালামও স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর ভিডিও বক্তব্য আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশাল সাড়া ফেলে এবং মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার করে।
অতীতে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনে মামলা-হামলা, হয়রানি ও পরিবারের সদস্যদের হয়রানির মতো কৌশল অবলম্বন করেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, দেশ ছেড়ে যাওয়া সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্টদের পরিবারগুলোকে হয়রানি করা এবং তাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে দমনের চেষ্টা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ড. কনক সারোয়ার ও তাঁর বোন নুসরাত শাহরিনের ঘটনা দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারের দমন-পীড়ন, গণতন্ত্র হরণের ঘটনা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে। তারা প্রবাসী সমালোচকদের স্বজনদের হয়রানি এবং মিথ্যা মামলাগুলোর অবসানের জন্য বারবার দাবি জানিয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ আশা করেছিলেন যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এসব নিপীড়িত ব্যক্তিদের সম্মান ও তাঁদের নামে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হবে। নাগরিকরা চেয়েছিল, এসব সাহসী সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। তবে, এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা জনগণের আশাভঙ্গের কারণ হয়েছে।
স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এসব সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের অবদান অতুলনীয়। দেশ থেকে নির্বাসিত অবস্থায়ও তাঁদের সাহসিকতা দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রেখেছে। তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি না দিয়ে এবং দেশে ফেরার উপায় না করে দিলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে নৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব সাহসী ব্যক্তিদের প্রাপ্য সম্মান জানানো ও তাঁদের বিরুদ্ধে থাকা মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করা উচিত।
Leave a Reply