আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৭ পূর্বাহ্ন
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডটি ইসরায়েলি বাহিনীর দক্ষিণ গাজা অঞ্চলে চালানো এক অভিযানের ফলাফল। হামাস এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা, বিশেষত সিএনএন এবং বিবিসি, এই হত্যার পদ্ধতি এবং ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার ছিলেন হামাসের সামরিক শাখার প্রধান এবং ১৯৮০ এর দশক থেকে গাজার মধ্যে সক্রিয়ভাবে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন। তিনি ইসরায়েলি সরকার এবং সামরিক বাহিনীর একটি লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। সিনওয়ার ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হলেও ইসরায়েলের জন্য তিনি একটি প্রধান হুমকি ছিলেন।
বিবিসি এবং সিএনএন-এর রিপোর্ট অনুসারে, ১৮ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) গাজার দক্ষিণাঞ্চলে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। আইডিএফের ৮২৮তম বিসলামাক ব্রিগেডের একটি ইউনিট রাফাহ অঞ্চলের তাল আল-সুলতান এলাকায় টহল দিচ্ছিল। এ সময় তারা তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে এবং বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষে তিনজনই নিহত হয়। তবে এই সংঘর্ষকে প্রথমে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে নিশ্চিত করা হয় যে তাদের মধ্যে একজন হলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার, হামাসের সামরিক প্রধান।
এই হত্যাকাণ্ডটি একদম প্রত্যাশিত ছিল না, কেননা সংঘর্ষটি সাধারণ একটি সশস্ত্র প্রতিরোধের অংশ হিসেবে শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়েছিল। আইডিএফের কর্মকর্তারা প্রথমে ঘটনাটির গুরুত্ব বুঝতে পারেননি, এবং সংঘর্ষস্থলে ফিরে গিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। পরে তারা নিশ্চিত হন যে নিহতদের মধ্যে একজন হামাসের প্রধান নেতা ছিলে
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এই অভিযানকে একটি বড় সাফল্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু তাদের জন্য একটি বড় বিজয় এবং এটি গাজার নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতাকে হ্রাস করবে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সিনওয়ারের মৃত্যুর ফলে হামাসের সামরিক কর্মকাণ্ড ও তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটবে।
হামাস, তাদের পক্ষ থেকে, ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে শহীদ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারা বলেছে, তার মৃত্যু ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনকে আরও জোরদার করবে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণে তারা আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। হামাসের সামরিক শাখার মুখপাত্র জানিয়েছেন, “ইসরায়েলের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমাদের সাহসিকতাকে দমাতে পারবে না। আমরা আমাদের নেতাদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত।
সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এই ঘটনার পর পরিস্থিতি শান্ত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে একইসঙ্গে ইসরায়েলের স্ব-প্রতিরক্ষা অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন এবং একে ফিলিস্তিনের জনগণের উপর একটি বর্বর আক্রমণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সিনওয়ার ছিলেন হামাসের অন্যতম শীর্ষ নেতা, এবং তার মৃত্যু সংগঠনের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হামাস ইতিমধ্যে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করেছে। সিনওয়ারের মৃত্যুর ফলে নতুন নেতা নির্বাচন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং হামাস তাদের সামরিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
হামাস সাধারণত দ্রুত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়, এবং এটি ধারণা করা হচ্ছে যে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুনভাবে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করতে পারে। তবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীও তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে গাজা সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং যেকোনো আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুত রয়েছে।
বিবিসি এবং সিএনএন-এর প্রতিবেদনে হামাসের অভ্যন্তরীণ সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, সিনওয়ার বেশ কিছুদিন ধরেই ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। তার উপর নজরদারি ছিল, এবং ইসরায়েলি বাহিনী তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। যদিও তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া কঠিন ছিল, তবুও এই টহল অভিযানের সময় তার উপস্থিতি ইসরায়েলের জন্য একটি সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সংঘর্ষের সময় ইসরায়েলের ড্রোনও ব্যবহার করা হয়েছিল, যা সিনওয়ারের অবস্থান সনাক্ত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
আরো জানুন ……. ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু নিয়ে ইসরায়েলি চিকিৎসকের ময়নাতদন্তে নতুন তথ্য
ইয়াহিয়া সিনওয়ার ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি হামাসের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডকে আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী করতে মূল ভূমিকা পালন করেন। তার নেতৃত্বে, হামাস গাজা থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সফল রকেট হামলা চালায়। তার কৌশলগত দক্ষতা এবং দৃঢ়সংকল্প তাকে গাজার জনগণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
তার মৃত্যু হামাসের জন্য একটি বড় ধাক্কা হলেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, সিনওয়ার একটি দীর্ঘমেয়াদী উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। তার নেতৃত্বে হামাস একটি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী সামরিক সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠেছে, যা ভবিষ্যতে তার আদর্শ এবং কৌশল অনুসরণ করে কাজ চালিয়ে যাবে।
সিনওয়ার হত্যাকাণ্ড গাজা এবং ইসরায়েলি অঞ্চলের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী সংঘর্ষকে আরও তীব্র করতে পারে। বিশেষ করে গাজা অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যেতে পারে, এবং নতুন করে সহিংসতা দেখা দিতে পারে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই ঘটনার পর ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনার পথ আরও সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে, কারণ দুই পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে।
ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। ইসরায়েলি বাহিনীর এই অভিযান গাজার রাজনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এটি স্পষ্ট যে, এই হত্যাকাণ্ড নতুন করে সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালতে পারে।
Leave a Reply