আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি গুরুতর অভিযোগ—শেখ পরিবারের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকল্পের অনুমোদন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার, তাদের ক্ষমতার সময়ে, প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের চাপে বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।
এসব প্রকল্প যাতে সহজে পাস করানো যায়, সে জন্য শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গত ১৫ বছরে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৩৮টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে এবং বাকি ৪৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে।
প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র, সাফারি পার্ক, দৃষ্টিনন্দন ভবন, নভোথিয়েটার, আইসিটি, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠার নামে। এই প্রকল্পগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, ছেলে শেখ কামাল এবং শেখ রাসেলের নাম।
এ ছাড়া শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের নামে আরও ৪৩টি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। তবে, এসব প্রকল্প অনুমোদনের আগেই সরকারের পতন ঘটে।
সরকারি নথিপত্রের পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ স্থাপনে শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। ১২টি প্রকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ১১টি প্রকল্পে এই নাম ব্যবহৃত হয়েছে, যা দ্বিতীয় সর্বাধিক। অন্যদিকে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রকল্পগুলোতেও শেখ পরিবারের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
জেলা পর্যায়ে প্রকল্পগুলোর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ পরিবারের নামে নেওয়া অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও তা কাজে আসছে না। স্থাপনা নির্মাণ করার পর পড়ে রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের কারণে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে।
এর মধ্যে কিছু প্রকল্প প্রভাবশালী মন্ত্রীদের চাপে, কিছু রাজনৈতিক বিবেচনায়, কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের প্ররোচনায় এবং কিছু ঠিকাদারদের পরামর্শে নেওয়া হয়েছে। ফলে এই প্রকল্পগুলোতে অর্থের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হয়েছে, কিন্তু কোনও জবাবদিহি নেই।
যশোরে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার নামে নির্মিত একটি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে; কিন্তু পার্কটি তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বর্তমানে, এই পার্কটি লোকসান গুনছে, এবং শেষ পর্যন্ত এটি সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
একইভাবে, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ কামালের নামে নির্মিত আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরটি প্রায় অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে।
শেখ পরিবারের নামের ব্যবহার অন্য প্রকল্পগুলোতেও প্রশ্ন উঠেছে। সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কের উদাহরণ দিয়েই বলা যায়, এখানে জমি বরাদ্দ নিয়ে আইটি পার্কের বদলে ইলেকট্রনিক, হোটেল এবং রেস্তোরাঁ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জনগণের টাকা আত্মসাতের বহুমুখী উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো শেখ পরিবারের নাম ব্যবহার করে প্রকল্প গ্রহণ।
এই পরিবারের নাম ব্যবহার করে প্রকল্প গ্রহণ করলে কেউ প্রশ্ন তুলতে সাহস পেত না। এইভাবে একটি পরিবারতন্ত্রের জন্ম হয়েছে, যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর, শেখ পরিবারের নাম পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
যেমন, সম্প্রতি শেখ হাসিনার নামে একটি ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে “জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট” করা হয়েছে। একইভাবে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম পরিবর্তনের পরিকল্পনা নিয়েও কাজ চলছে।
এই সমস্ত প্রকল্পের বিশদ বিবরণ দেখে মনে হয়, শেখ পরিবারের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকল্পের অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় প্রচুর অর্থ অপচয় হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোতে প্রয়োজনীয় জবাবদিহি না থাকার ফলে সরকারি অর্থের অপচয় এবং জনগণের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত, যে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
Leave a Reply