আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৭ পূর্বাহ্ন
শিশুদের হৃদরোগের ঝুঁকি ছোট থেকেই থাকতে পারে। যদিও অনেকেই মনে করেন, হৃদরোগ মূলত বড়দের সমস্যা, তবে শিশুরাও এ ঝুঁকির বাইরে নয়। সঠিক যত্ন, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার মাধ্যমে শিশুদের হৃদয় ভালো রাখতে অভিভাবকদের কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। শিশুদের হৃদয় ভাল রাখতে বাবা-মায়েরা কী কী করতে পারেন, তা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
কেন ছোট থেকেই হৃদরোগের ঝুঁকি থাকতে পারে?
বিভিন্ন কারণেই শিশুরা ছোট বয়স থেকেই হৃদরোগের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। জেনেটিক ফ্যাক্টর যেমন পরিবারের কারও হৃদরোগের ইতিহাস থাকলে, শিশুদের মধ্যেও এর ঝুঁকি থাকতে পারে। এছাড়াও অনিয়মিত জীবনযাপন, অপুষ্টি, স্থূলতা এবং শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপনও হৃদরোগের কারণ হতে পারে।
শিশুর হৃদরোগের সাধারণ লক্ষণ
শিশুদের মধ্যে যদি হৃদরোগের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
দ্রুত বা অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন: শিশুদের হৃদস্পন্দন যদি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হয়, তাহলে এটি হৃদরোগের ইঙ্গিত হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট: যদি শিশু শ্বাস নিতে কষ্ট করে বা খেলার সময় তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, এটি হৃদযন্ত্রের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
সাইনোসিস: ত্বক, ঠোঁট বা নখের চারপাশে নীলচে রঙ দেখা গেলে, এটি শিশুর হৃদপিণ্ডে রক্তপ্রবাহের সমস্যা নির্দেশ করতে পারে।
ওজন বৃদ্ধির সমস্যা: যদি শিশু স্বাভাবিকভাবে ওজন না বাড়ায় বা বৃদ্ধি কম হয়, তা হলে এটি হৃদরোগের লক্ষণ হতে পারে।
শিশুদের হৃদরোগের প্রাথমিক কারণ
১. জেনেটিক প্রভাব
হৃদরোগের একটি বড় কারণ হতে পারে বংশগত জেনেটিক সমস্যা। পরিবারের কোনো সদস্য যদি হৃদরোগে ভোগেন, তাহলে শিশুর মধ্যেও এ ঝুঁকি থেকে যায়। তাই পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং প্রয়োজনে আগাম সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন।
২. অপুষ্টি ও অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস
শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকেই অপুষ্টিতে ভোগে, তাহলে তাদের হৃদযন্ত্র দুর্বল হতে পারে। ফাস্টফুড, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, চিনি ও প্রসেসড খাবার বেশি খাওয়া শিশুদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এর বদলে সুষম খাদ্যাভ্যাস শিশুর হার্ট ভালো রাখার অন্যতম উপায়।
৩. স্থূলতা
বর্তমানে শিশুদের মধ্যে স্থূলতার সমস্যা বাড়ছে, যা হৃদরোগের একটি বড় কারণ হতে পারে। স্থূলতা শুধু শারীরিক দিক থেকেই ক্ষতিকর নয়, এটি হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে, যা ভবিষ্যতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন
আজকের দিনে অনেক শিশুই বেশিরভাগ সময় বাড়িতে কাটায়, বিশেষ করে টিভি, ভিডিও গেম, বা স্মার্টফোনে। শারীরিক অনুশীলনের অভাব হৃদরোগের অন্যতম কারণ হতে পারে।
৫. উচ্চ রক্তচাপ
শিশুদের মধ্যেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। এটি একটি মারাত্মক সমস্যা হতে পারে, কারণ এটি সরাসরি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
আরো জানুন- প্যারাসিটামল সহ ৫২ ওষুধ ‘ফেল’
শিশুর হৃদয় ভাল রাখতে বাবা-মায়েরা কী করবেন?
১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা
শিশুদের হৃদয় সুস্থ রাখতে সুষম এবং পুষ্টিকর খাদ্য অপরিহার্য। বাবা-মায়েদের উচিত শিশুর খাদ্যাভ্যাসের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। ফাস্টফুড, প্রসেসড ফুড, চর্বিযুক্ত খাবার, এবং চিনি এড়িয়ে চলা উচিত। শিশুর ডায়েটে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, ফল, সঠিক প্রোটিন, এবং ভালো চর্বি থাকা জরুরি।
সবুজ শাকসবজি: শাকসবজি হৃদয়ের জন্য ভালো, কারণ এতে ফাইবার, ভিটামিন এবং মিনারেল থাকে যা হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
ফলমূল: বিশেষ করে বেরি, আপেল, নাশপাতি ইত্যাদি ফলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা হৃদয়ের জন্য ভালো।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, আখরোট, এবং চিয়া সিড হার্টের জন্য উপকারী।
ফাইবারযুক্ত খাবার: ফাইবার হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক, তাই শিশুর ডায়েটে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যুক্ত করা উচিত।
২. শারীরিক কার্যকলাপে উৎসাহিত করা
শিশুদের হৃদয় সুস্থ রাখতে শারীরিক অনুশীলন অপরিহার্য। বাবা-মায়েরা শিশুদের খেলা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, বা যেকোনো ধরণের শারীরিক কার্যকলাপে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে পারেন।
প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪০ মিনিট শারীরিক অনুশীলন শিশুরা করলে তাদের হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে।
দলগত খেলার মধ্যে থাকা শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক উন্নতি ঘটে।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
শিশুদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ওজন শিশুদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বাবা-মায়েদের উচিত শিশুর সঠিক ওজন বজায় রাখার জন্য তাদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক অনুশীলন নিশ্চিত করা।
৪. মানসিক চাপ কমানো
শিশুরা অনেক সময় মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে পারে, যা তাদের হৃদয়ের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বাবা-মায়েদের উচিত তাদের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং প্রয়োজনে মানসিক চাপ কমানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া।
৫. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
শিশুরা যদি কোনো ধরনের হৃদযন্ত্রের ঝুঁকিতে থাকে, তাহলে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রাথমিকভাবে যদি কোনো সমস্যা ধরা পড়ে, তবে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে অভ্যাস গড়ে তোলা
শিশুদের ছোটবেলা থেকেই কিছু ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, যা তাদের ভবিষ্যতে হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে। যেমন:
পর্যাপ্ত ঘুম: ঘুম হৃদয়ের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
পর্যাপ্ত পানি পান: পানি শরীরের সমস্ত ফাংশন সঠিকভাবে কাজ করতে সহায়ক। শিশুকে পর্যাপ্ত পানি পান করতে উৎসাহিত করুন।
অতিরিক্ত লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা: লবণ এবং চিনির অতিরিক্ত ব্যবহার হৃদযন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাবা-মায়ের সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ
বাবা-মায়েদের উচিত শিশুদের হৃদরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক অনুশীলন এবং সুস্থ জীবনযাত্রার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের সদস্যদের জেনেটিক ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন থাকাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে আগাম সতর্কতা নেওয়া সম্ভব।
শিশুদের হৃদয় সুস্থ রাখতে বাবা-মায়েদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পুষ্টি, শারীরিক অনুশীলন, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের মাধ্যমে শিশুদের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া হলে ভবিষ্যতে শিশুদের হৃদয় সুস্থ থাকবে, এবং হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
Leave a Reply