আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২৭ পূর্বাহ্ন
বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীদের খুশি করে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম প্রতিভাবান লেখক হান ক্যাং। সুইডেনের স্টকহোমে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক হ্যান্স এলেগ্রেন এই সম্মাননার ঘোষণা করেন।সুইডেনের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বেলা একটা (বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটা) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সংবাদটি প্রকাশিত হলে দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বজুড়ে সাহিত্যপ্রেমীরা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন।
হান ক্যাং একজন খ্যাতনামা লেখক, যার সাহিত্যে জীবন, সমাজ, এবং মানব প্রকৃতির গভীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। তার লেখার বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের জটিলতা এবং সমাজের গভীরে থাকা সাংস্কৃতিক সংকট। তার লেখা শুধু কোরিয়ার সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস “দ্য ভেজিটেরিয়ান” ২০১6 সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার জয় করে, যা তাকে বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করে তোলে।
হান ক্যাংয়ের সাহিত্যকর্ম সমাজের অন্তর্নিহিত সত্ত্বা, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, এবং সাংস্কৃতিক সংকটের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি তার লেখায় মানব জীবনের জটিলতা এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে মানবতার আসল চেহারা তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে তার উপন্যাসগুলোতে নারীচরিত্রের ভেতরের অস্থিরতা, স্বাধীনতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা এবং সামাজিক বাধ্যবাধকতাগুলোর মধ্যকার সংঘাতকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি তার পুরস্কারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, “হান ক্যাং তার সাহিত্যে মানব জীবনের গভীর সত্তা এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংকটকে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। তার লেখায় দার্শনিক বিষয়গুলোর গভীর অন্বেষণ এবং কল্পনার বিস্তৃত ভুবনের মধ্য দিয়ে মানবতার প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হয়েছে।”
আরও জানুন –চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যৌথভাবে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী
হান ক্যাংয়ের সাহিত্যজগতে তার সবচেয়ে পরিচিত কাজ হলো “দ্য ভেজিটেরিয়ান” (২০০৭)। এই উপন্যাসটি এক নারীর গল্প বলে, যিনি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিবেন, যার ফলে তার পারিবারিক জীবন এবং সম্পর্কের জটিলতা বৃদ্ধি পায়। উপন্যাসটি মূলত নারীর স্বাধীনতা, আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান, এবং সমাজের প্রথাগত ধারার বিপরীতে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে।
তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো “হিউম্যান অ্যাক্টস” (২০১৪), যা দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু গণহত্যার উপর ভিত্তি করে লেখা। এই উপন্যাসে হান ক্যাং মানুষের সহিংসতার প্রতি প্রতিক্রিয়া, সংগ্রাম, এবং জীবনের মূল্য নিয়ে গভীর দর্শন তুলে ধরেছেন। এটি তার সাহিত্যকর্মের একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়, যেখানে তিনি মানুষের যন্ত্রণা এবং সহিংসতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানবতার প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছেন।
হান ক্যাংয়ের নোবেল জয় শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্যজগতে এক বিরল সম্মান। দক্ষিণ কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরে তার সাহিত্যিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। কোরিয়ার সাহিত্য বিশেষ করে ২০শ শতাব্দীর রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। হান ক্যাং সেই ধারাবাহিকতায় নতুন রূপ দিয়ে কোরিয়ার সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
নোবেল পুরস্কার পৃথিবীর অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার, যা মানুষের জীবনে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্মান জানায়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার সেই সকল লেখকদের প্রদান করা হয়, যারা তাদের লেখায় মানবতার গভীর প্রশ্ন, সমাজের সংকট এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়গুলোকে তুলে ধরেন। হান ক্যাংয়ের এই সম্মাননা তাকে দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সাহিত্যের এক কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
হান ক্যাংয়ের সাহিত্যজগতে অবদান আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। তার লেখায় মানবিক অনুভূতি, নারীর আত্মপরিচয়, এবং সমাজের মনস্তাত্ত্বিক সংকট অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি এমন একটি সাহিত্যের ধারাকে প্রবর্তন করেছেন, যা কেবল পাঠককে বিনোদন দেয় না, বরং তাদেরকে ভাবিয়ে তোলে এবং সমাজের গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। তার কাজগুলোতে কোরিয়ার সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনের প্রতি গভীর দর্শন রয়েছে।
হান ক্যাং ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবাও ছিলেন একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক। তার লেখালেখির জীবন শুরু হয় কবিতা দিয়ে, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি গল্প এবং উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটান। তার প্রথম উপন্যাস “রেড অ্যাঙ্কলেট” ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে পাঠক এবং সমালোচকদের নজর কাড়ে।
হান ক্যাংয়ের সাহিত্যিক জীবন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং সমাজের পরিস্থিতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। গুয়াংজু গণহত্যার মতো সামাজিক সংকট এবং ব্যক্তিগত জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো তার লেখায় বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
হান ক্যাং শুধু নোবেল পুরস্কারেই সীমাবদ্ধ নন, তার সাহিত্যকর্ম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছে। তার সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর মধ্যে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার অন্যতম। ২০১৬ সালে “দ্য ভেজিটেরিয়ান” উপন্যাসের জন্য তিনি এই পুরস্কার জিতেন, যা তাকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। এছাড়াও তিনি কোরিয়ায় বেশ কিছু সাহিত্য পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন।
হান ক্যাংয়ের সাহিত্যকর্ম সমাজের গভীর সমস্যা এবং ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার জটিলতাগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তার লেখায় যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং দর্শনের প্রভাব রয়েছে, তা ভবিষ্যত প্রজন্মের লেখকদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তার সাহিত্যের ধারা কেবল কোরিয়ায় নয়, বরং আন্তর্জাতিক সাহিত্যজগতে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
হান ক্যাংয়ের ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কার জয় কেবল তার নিজের সাফল্য নয়, বরং এটি দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্যজগতে একটি বিশাল অর্জন। তার লেখায় যে গভীরতা এবং মানসিক উত্তেজনা রয়েছে, তা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার সাহিত্যকর্ম আন্তর্জাতিক মহলে কোরিয়ার সাহিত্যকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তার অবদানের জন্য তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
হান ক্যাং তার লেখায় মানুষের জীবন, সম্পর্ক, এবং সামাজিক সংকটের গভীর দর্শন তুলে ধরেছেন, যা তাকে ইতিহাসের পাতায় চিরকাল ধরে রাখবে।
Leave a Reply