ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে টেস্ট ক্রিকেটে আরেকটি হতাশাজনক দিন যোগ হলো, যখন বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৪৬ রানে অলআউট হয়ে গেল ভারতীয় দল। এই স্কোর ভারতের টেস্ট ক্রিকেটে তৃতীয় সর্বনিম্ন এবং দেশের মাটিতে সর্বনিম্ন স্কোর হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। টিম ইন্ডিয়ার পাঁচজন ব্যাটার কোনো রান না করে আউট হওয়ার ঘটনা ঘটে, যা দলটির জন্য গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়।
এই টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনটি বৃষ্টির কারণে পুরোপুরি ভেসে গেলেও দ্বিতীয় দিনেই নিউজিল্যান্ডের বোলাররা ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। লাঞ্চের আগে ভারতের স্কোরবোর্ডে মাত্র ৩৪ রান তুলতে সক্ষম হয় দলটি, কিন্তু তারা এর মধ্যেই হারিয়ে ফেলে ৬টি মূল্যবান উইকেট। ভারতের এই ধ্বংসস্তূপের পেছনে মূলত নিউজিল্যান্ডের পেসারদের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং দায়ী, যেখানে টিম সাউদি, ম্যাট হেনরি এবং উইল ও’রুর্কি দুর্দান্ত বল করেন।
ভারতের ব্যাটিং বিপর্যয়
টিম ইন্ডিয়ার পক্ষে প্রথম ইনিংসে বড় কোনো জুটি গড়ে তোলার মতো কেউই ছিলেন না। ওপেনিং ব্যাটসম্যান যশস্বী জয়সওয়াল এবং ঋষভ পান্ত কেবল কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। যশস্বী জয়সওয়াল ৬৩ বলে ১৩ রান করেন, যা দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর। অন্যদিকে ঋষভ পান্ত ৪১ বলে ১৫ রান করে অপরাজিত থেকে লাঞ্চ বিরতিতে যান, কিন্তু তার এ ইনিংসও দলের পতন রুখতে পারেনি।
ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা, যিনি টিমের ওপর অনেক ভরসা করেছিলেন, তিনি মাত্র ২ রান করে টিম সাউদির বলে আউট হন। এর পরের সময়টি ছিল নিউজিল্যান্ডের পেসারদের আধিপত্যের। বিশেষ করে টিম সাউদি এবং ম্যাট হেনরি ভারতীয় ব্যাটারদের উপর অসাধারণ আক্রমণ চালিয়ে তাদের দ্রুত প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠান।
পাঁচজন ব্যাটসম্যান শূন্য রানে আউট
শূন্য রানে আউট হওয়া ব্যাটসম্যানদের তালিকায় রয়েছেন বিরাট কোহলি, সরফরাজ খান, লোকেশ রাহুল, রবীন্দ্র জাদেজা এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন। কোহলি এবং সরফরাজ, দুজনেই ডেভন কনওয়ের অসাধারণ ক্যাচে আউট হন, যা নিউজিল্যান্ডের ফিল্ডিং দক্ষতার আরেকটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। কোহলি উইল ও’রুর্কির বলে লেগ গালিতে গ্লেন ফিলিপ্সের দুর্দান্ত ক্যাচে আউট হন। পরের ওভারে ম্যাট হেনরির বলে সরফরাজ খানও আউট হয়ে যান। লোকেশ রাহুল এবং রবীন্দ্র জাদেজাও শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন।
বিরাটের ডাক ‘0’
এই ম্যাচে ভারতের জন্য পাঁচজন ব্যাটার শূন্য রানে আউট হওয়ার ঘটনা কোনো নতুন ঘটনা নয়। টেস্ট ক্রিকেটে এটি ষষ্ঠবারের মতো ঘটলো। তবে এই ঘটনাটি ভারতের জন্য বিশেষ করে লজ্জাজনক, কারণ এটি তাদের নিজেদের মাটিতে ঘটে এবং পুরো ব্যাটিং লাইনআপ বিপর্যস্ত হয়।
নিউজিল্যান্ডের পেসারদের দাপট
নিউজিল্যান্ডের বোলিং আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত। টিম সাউদি এবং ম্যাট হেনরির নেতৃত্বে কিউই পেসাররা ভারতীয় ব্যাটারদের দিশেহারা করে তোলেন। ম্যাট হেনরি এই ম্যাচে তার ১০০তম টেস্ট উইকেট লাভ করেন, যা তার টেস্ট ক্যারিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সাউদি, হেনরি এবং ও’রুর্কি মিলে ভারতের জন্য দুঃস্বপ্নের একটি ইনিংস গড়ে তোলেন।
৫ উইকেট নিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ারে ১০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁলেন ম্যাট হেনরি
সাউদি ছিলেন প্রথম যিনি রোহিত শর্মাকে আউট করে ভারতের পতনের সূচনা করেন। এরপর হেনরি ও ও’রুর্কি একে একে বাকি ব্যাটসম্যানদের আউট করেন। বোলিংয়ের পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডের ফিল্ডারদের পারফরম্যান্সও ছিল অসাধারণ, বিশেষ করে ডেভন কনওয়ে এবং গ্লেন ফিলিপ্সের ক্যাচগুলো দলের জন্য বড় ভূমিকা পালন করে।
আরো পড়ুন- এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ এশিয়ান কাপে নতুন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল দলের
ভারতের টেস্ট ইতিহাসে নিম্নতম স্কোরের তালিকা
ভারতের টেস্ট ইতিহাসে নিম্নতম স্কোরগুলোর মধ্যে এই ৪৬ রানের ইনিংস একটি দুঃখজনক সংযোজন। এর আগে ভারতের সর্বনিম্ন স্কোর ছিল ৪২, যা ১৯৭৪ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হয়েছিল। এছাড়া ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ডারবানে ৬৬ রানে অলআউট হওয়াও ভারতের আরেকটি নিম্নতম স্কোরের উদাহরণ।
পরবর্তী করণীয়
এই ব্যাটিং বিপর্যয় ভারতের জন্য একটি কঠিন সময় হিসেবে বিবেচিত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের ব্যাটসম্যানদের এইভাবে হোঁচট খাওয়া তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দিতে পারে। তবে ভারতীয় দলকে দ্রুত এই হতাশা কাটিয়ে উঠে পরবর্তী ইনিংসে শক্তভাবে ফিরে আসার জন্য মানসিক ও কৌশলগতভাবে প্রস্তুত হতে হবে। ভারতের কোচিং স্টাফ এবং দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের এই ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর দলকে মনোবল শক্ত করার জন্য বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের টেকনিক্যাল সমস্যা এবং নিউজিল্যান্ডের পেসারদের দক্ষতার বিরুদ্ধে তাদের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ফাস্ট বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ভারতের টপ অর্ডারের স্থায়িত্ব নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়দের মানসিক দৃঢ়তা এবং প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
নিউজিল্যান্ডের সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নিউজিল্যান্ডের পেস আক্রমণের প্রশংসা না করলেই নয়। তারা ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপকে ভেঙে দিয়ে টেস্টের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে। কিউই দলের বোলারদের নিখুঁত লাইন-লেংথ এবং ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে তাদের দুর্দান্ত পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে তাদের দলকে বড় সফলতা এনে দিয়েছে। ম্যাট হেনরি, সাউদি, এবং ও’রুর্কি যে সমন্বয়ে বল করেছেন, তা দেখার মতো ছিল।
এখন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের দলটি ভারতের বিরুদ্ধে চালিয়ে আসা তাদের আক্রমণাত্মক স্টাইল বজায় রেখেছে। তাদের এই পারফরম্যান্স আগামী দিনে দলটিকে আরও শক্তিশালী করবে এবং তারা ভারতীয় দলের ওপর মানসিক চাপ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে।
ভারতের ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের রেকর্ড
নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের মাটিতে তাদের খেলার রেকর্ড বিশেষভাবে উন্নত নয়। তবে, এবারের টেস্টে নিউজিল্যান্ডের এই অসাধারণ পারফরম্যান্স তাদের জন্য নতুন একটি যুগের সূচনা হতে পারে। কিউই দলের বোলিং আক্রমণ এবং মাঠে তাদের তীক্ষ্ণ ফিল্ডিং তাদেরকে ভারতের বিপক্ষে একটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
Leave a Reply