আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৯ পূর্বাহ্ন
বাইপোলার ডিসঅর্ডার (Bipolar Disorder) একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যা একজন ব্যক্তির মেজাজ, শক্তি এবং কার্যক্রমে অস্বাভাবিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে, যা পূর্বে ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার নামে পরিচিত ছিল। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনও চরম উচ্ছ্বাস (ম্যানিয়া) এবং কখনও চরম বিষণ্ণতায় (ডিপ্রেশন) ভুগতে পারেন। এই দুই অবস্থার মধ্যে স্বাভাবিক মেজাজে ফিরে আসতে তারা দীর্ঘ সময় নিতে পারেন। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং গুরুতর মানসিক অসুস্থতা, যা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যা মেজাজের চরম পরিবর্তন, যেমন অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস বা হতাশার (ডিপ্রেশন) মধ্যে নিয়ে আসে। বাইপোলার রোগীরা কখনও খুব বেশি আনন্দিত, আত্মবিশ্বাসী এবং উদ্দীপিত বোধ করেন, আবার কখনও তারা প্রচণ্ড বিষণ্ণ, হতাশ এবং ক্লান্ত বোধ করতে পারেন। এই চরম মেজাজ পরিবর্তনগুলি সাধারণত কয়েক দিন, সপ্তাহ বা মাস ধরে স্থায়ী হতে পারে এবং এর প্রভাব তাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা না গেলেও, বেশ কিছু কারণ এই রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। এই কারণগুলো সাধারণত জেনেটিক, মস্তিষ্কের রসায়ন এবং পরিবেশগত প্রভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার জেনেটিক কারণে ঘটতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তির পরিবারে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ইতিহাস থাকে, তবে তার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পরিবারের একাধিক সদস্য এই রোগে আক্রান্ত হলে ঝুঁকি আরও বাড়ে।
মস্তিষ্কের কিছু রসায়ন যেমন সেরোটোনিন, ডোপামিন, এবং নোরপাইনেফ্রিনের ভারসাম্যহীনতা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই রসায়নিকগুলো মস্তিষ্কের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এবং যদি এদের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, তবে মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে পরিবেশগত কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শৈশবের মানসিক আঘাত, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, মানসিক চাপ, অথবা অন্যান্য মানসিক আঘাত এই রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সঙ্গে হরমোনের পরিবর্তনেরও সম্পর্ক থাকতে পারে। হরমোনের মাত্রা বেড়ে বা কমে গেলে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে এবং মেজাজের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
আরো পড়ুন- সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia): কারণ, লক্ষণ, এবং চিকিৎসা
বাইপোলার ডিসঅর্ডারকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়:
এই ধরনের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ম্যানিক পর্বগুলো চরম মাত্রায় পৌঁছে যায়। ব্যক্তির মেজাজ এতটাই উচ্ছ্বসিত হয় যে তিনি বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেন এবং বিভিন্ন অস্বাভাবিক কার্যকলাপ শুরু করেন। এই অবস্থায় তারা প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হন।
এই ধরনের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে হাইপোম্যানিয়া নামক একটি কম গুরুতর ম্যানিক পর্ব দেখা দেয়। এটি ম্যানিক পর্বের তুলনায় কম গুরুতর, তবে বিষণ্ণতার পর্বগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর হয়।
এই ধরনের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে মেজাজের পরিবর্তন হয়, তবে ম্যানিক বা বিষণ্ণতার পর্বগুলো বাইপোলার ১ বা ২ ডিসঅর্ডারের মতো চরম নয়। এটি একটি মৃদু ধরনের বাইপোলার ডিসঅর্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই ধরনের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে মেজাজের পরিবর্তন ঘটে, তবে এগুলো বাইপোলার ১ বা ২ এর মতো নয়। এর মধ্যে বিভিন্ন পরিবেশগত বা শারীরিক কারণও জড়িত থাকতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো প্রধানত ম্যানিয়া (উচ্ছ্বাস) এবং ডিপ্রেশনের (বিষণ্ণতা) মধ্যে বিভক্ত। নিচে এই দুটি পর্বের লক্ষণগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
রোগী খুব বেশি আনন্দিত, উদ্দীপিত এবং উত্তেজিত বোধ করেন, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করে।
রোগী নিজের প্রতি অস্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে শুরু করেন।
রোগী অনেক সময় অসংলগ্নভাবে কাজ করেন, যেমন টাকা খরচ করে ফেলা, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ করা ইত্যাদি।
রোগী প্রায়ই অন্যদের সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে বেশি কথা বলেন এবং তাদের থামানো কঠিন হয়ে পড়ে।
মানসিক উত্তেজনার কারণে রোগী প্রায়ই কম ঘুমান, তবে তারা তবুও শক্তি এবং উদ্দীপনা অনুভব করেন।
রোগী খুব বেশি বিষণ্ণতা অনুভব করেন এবং জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাদের মাঝে প্রচণ্ড হতাশা দেখা যায়।
রোগী সব সময় ক্লান্ত বোধ করেন এবং কোনো কাজ করার ইচ্ছা বা উদ্দীপনা থাকে না।
রোগী নিজের প্রতি অপরাধবোধে ভোগেন এবং সব সময় নিজেকে তুচ্ছ এবং অযোগ্য মনে করেন।
বিষণ্ণতার সময় অনেক রোগীর আত্মহত্যার চিন্তা বা প্রচেষ্টা দেখা দেয়। এটি বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সবচেয়ে গুরুতর এবং বিপজ্জনক লক্ষণ।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার দীর্ঘমেয়াদী একটি মানসিক অসুস্থতা হলেও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সাধারণত, এই রোগের চিকিৎসা তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের চিকিৎসায় লিথিয়াম, অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ, এবং অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধ রোগীর মেজাজের পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয় এবং ম্যানিয়া বা বিষণ্ণতার পর্বগুলো প্রতিরোধ করতে সহায়ক।
সাইকোথেরাপি, যেমন কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) এবং ইন্টারপার্সোনাল থেরাপি (IPT), রোগীর মানসিক আচরণ পরিবর্তন করতে সহায়ক হয়। এই থেরাপির মাধ্যমে রোগীরা তাদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হন এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করতে হয়, সে সম্পর্কে শিখেন।
বাইপোলার রোগীদের নিয়মিত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন এবং যোগব্যায়ামও সহায়ক হতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। যেমন:
রোগীর মেজাজ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে।
মানসিক চাপ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা অন্যান্য শিথিলকরণমূলক কার্যক্রম করা উচিত।
পর্যাপ্ত এবং সঠিক ঘুম রোগীর মেজাজ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
Leave a Reply