আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩৭ পূর্বাহ্ন
বিশ্ব পর্যটন দিবস আজ । বিশ্ব পর্যটন দিবস (World Tourism Day) প্রতিবছর ২৭ সেপ্টেম্বর পালিত হয়। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) ১৯৮০ সালে এ দিবসটি পালনের সূচনা করে। বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পের সচেতনতা বৃদ্ধি, পর্যটনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরা এবং টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করা এর মূল লক্ষ্য। প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে এই দিবস পালিত হয়, যার মাধ্যমে পর্যটন খাতের বৈচিত্র্যময় দিকগুলো তুলে ধরা হয়।
পর্যটন একটি প্রাচীন কার্যকলাপ হলেও আধুনিক যুগে এটি বিপুল পরিমাণে বিকশিত হয়েছে। মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন কারণে ভ্রমণ করেছে—ধর্মীয় উদ্দেশ্যে, নতুন ভূমি আবিষ্কার, ব্যবসা-বাণিজ্য বা রোমাঞ্চের খোঁজে। ১৯শ শতাব্দীতে, যখন পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে, তখন থেকে ভ্রমণ সহজ এবং সাশ্রয়ী হয়। পর্যটন এখন একটি ব্যাপক শিল্পে পরিণত হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক বিনিময়, এবং পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বিশ্ব পর্যটন শিল্প পৃথিবীর অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও বিশ্বব্যাংকের মতে, বিশ্বব্যাপী পর্যটন খাত প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক লেনদেন করে। এর ফলে এই খাতটি বিভিন্ন দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পর্যটন একটি প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস।
পর্যটন কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি দেশ ও সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে, যা বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষকে একসাথে নিয়ে আসে। পর্যটনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, খাদ্য, ভাষা, এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায়। পর্যটকরা যখন অন্য কোনো দেশে যান, তখন তারা স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে যান এবং তাদের জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত হন। এর ফলে পারস্পরিক সহনশীলতা ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
আরও জানুন – অনুমতি ছাড়া সেন্টমার্টিনে যেতে পারবে না পর্যটকরা: পরিবেশ রক্ষায় কড়াকড়ি নির্দেশনা
তবে পর্যটন শিল্পের দ্রুত সম্প্রসারণ পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অযাচিত পর্যটনের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হওয়া, বন্যপ্রাণীর জন্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হওয়া এবং পরিবেশ দূষণ অন্যতম সমস্যা। এ কারণে বর্তমানে টেকসই পর্যটনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। টেকসই পর্যটন বলতে এমন পর্যটনকে বোঝায়, যেখানে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে এনে দীর্ঘমেয়াদি উপকারিতা অর্জন করা হয়।
জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) টেকসই পর্যটনকে এমন একটি রূপ হিসেবে বিবেচনা করে, যা স্থানীয় জনগণ এবং তাদের পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এটি প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করে, স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটায় এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য পর্যটন প্রচার করে।
প্রযুক্তির বিকাশ ও বিশ্বায়নের প্রভাবের ফলে পর্যটন শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ইন্টারনেটের সাহায্যে এখন পর্যটকরা খুব সহজেই বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্য সম্পর্কে তথ্য পেতে পারেন এবং নিজেরা ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে পারেন। পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে বিশ্বব্যাপী অজানা বা অল্প পরিচিত পর্যটন গন্তব্যগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
তবে আধুনিক পর্যটন শিল্পে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ব পর্যটন শিল্পে বিশাল আঘাত লেগেছে। মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পর্যটন খাত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যদিও বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ পুনরায় শুরু হয়েছে, তবে এই শিল্পকে সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করতে সময় লাগবে। তাই বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পের সচেতনতা বৃদ্ধি মূল লক্ষ্য ।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও পর্যটন খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক পর্যটন গন্তব্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধ্বংসের মুখে পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, মালদ্বীপের মতো দেশের দ্বীপগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই পর্যটনের সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতেও এই গন্তব্যগুলো টিকে থাকে।
বিগত কয়েক দশকে পর্যটন খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দ্রুত বেড়েছে। ভ্রমণ এখন সহজ এবং সাশ্রয়ী হয়েছে, যার ফলে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী বছরগুলোতে পর্যটন শিল্পে আরও অনেক উন্নয়ন দেখা যাবে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-এর মতো নতুন প্রযুক্তি পর্যটন খাতে বিপ্লব ঘটাতে চলেছে। এসব প্রযুক্তির সাহায্যে পর্যটকরা বাড়িতে বসেই বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যের অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন।
এছাড়া, ভবিষ্যতের পর্যটন খাতে “স্মার্ট পর্যটন” বা “ইকো-ফ্রেন্ডলি পর্যটন” ধারণা বাড়তে থাকবে। যেখানে পরিবেশ রক্ষা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে। টেকসই পর্যটনকে সামনে রেখে এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে যেখানে পর্যটন খাত আর্থিকভাবে লাভজনক হবে, কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা অপরিসীম। দেশটির সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। বিশেষত কক্সবাজারের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য অনেক পর্যটকের কাছে জনপ্রিয়। বাংলাদেশের পর্যটন খাত দেশের অর্থনীতির অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এই খাতের উন্নয়ন কিছুটা ধীরগতিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে পরিবেশ সুরক্ষা, পর্যটন স্থানগুলোর নিরাপত্তা ও পর্যটকদের জন্য মানসম্মত সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের প্রচার ও পর্যটন স্থাপনাগুলোর উন্নয়ন করতে হবে।এজন্য দেশবাসীর বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পের সচেতনতা বৃদ্ধি মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ।
বিশ্ব পর্যটন দিবস আজ । তাই এটি পর্যটন শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। এটি কেবল পর্যটকদের জন্য একটি উৎসবের দিন নয়, বরং এর মাধ্যমে পর্যটন খাতের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। পর্যটন কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটে। তবে এর সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় রাখতে হবে। টেকসই পর্যটনকে সামনে রেখে আমরা একটি উন্নত এবং দায়িত্বশীল পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি, যা বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য উপকারী হবে।
Leave a Reply