আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৩ পূর্বাহ্ন
বিশ্বের দরিদ্রতম ১০টি দেশের তালিকা তৈরির সময় মূলত কিছু অর্থনৈতিক সূচকের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মোট দেশজ উৎপাদন (GDP), মাথাপিছু আয় (GDP per capita), জীবনযাত্রার মান, মানব উন্নয়ন সূচক (HDI), শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং অবকাঠামো অন্যতম সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব দেশের অনেকেই যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্যোগ, দুর্নীতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবে দরিদ্রতায় নিমজ্জিত। এছাড়া, এসব দেশগুলোতে খাদ্যাভাব, বেকারত্ব এবং অশিক্ষা অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরও তীব্র করেছে।
এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম ১০টি দেশের তালিকা এবং তাদের আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করবো। এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমস্যা এবং কিভাবে তা দুর করতে পারা যেতে পারে, তা নিয়ে বিশ্লেষণও থাকবে।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ২৬৪ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: পূর্ব আফ্রিকা।
বুরুন্ডি বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর অর্থনীতি প্রধানত কৃষির উপর নির্ভরশীল, কিন্তু কৃষি খাতও যথেষ্ট উন্নত নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত দেশের দরিদ্রতার অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া, দেশটিতে শিক্ষার নিম্নমান এবং স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেম অত্যন্ত দুর্বল। অপুষ্টি, উচ্চ শিশু মৃত্যুর হার, এবং বেকারত্ব দেশটির জনগণের জন্য সাধারণ সমস্যা।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৩১৫ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: পূর্ব আফ্রিকা।
দক্ষিণ সুদান ২০১১ সালে সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তবে তার পর থেকেই দেশটি গৃহযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক সংঘাতে নিমজ্জিত। দেশটির অর্থনীতি মূলত তেল সম্পদের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তার অভাবে তেলের উৎপাদন নিয়মিতভাবে ব্যাহত হয়। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মান অত্যন্ত নিম্নমানের এবং দেশের বেশিরভাগ জনগণ চরম দারিদ্র্যে বসবাস করে।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৩৪২ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকা।
মালাউই আফ্রিকার অন্যতম দরিদ্র দেশ। এর অর্থনীতি কৃষির উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, এবং দেশের বেশিরভাগ জনগণ খাদ্য উৎপাদন ও কৃষির সাথে জড়িত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন খরা এবং বন্যা, কৃষি উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শিক্ষার মান কম, এবং স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা খুবই খারাপ, যা দেশের দরিদ্রতার অবস্থা আরও বৃদ্ধি করেছে। অপুষ্টি এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মালাউইর সাধারণ সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৪৪৯ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকা।
মোজাম্বিক প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে ধনী হলেও দেশটির উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। দেশটির বেশিরভাগ জনগণ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে এবং তাদের জীবিকা মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এবং অবকাঠামো উন্নয়নের অভাব মোজাম্বিকের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৪৮৬ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: মধ্য আফ্রিকা।
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ এবং দীর্ঘকাল ধরে সংঘাত, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত। দেশের বেশিরভাগ মানুষই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এবং তাদের জীবিকা কৃষির উপর নির্ভরশীল। যদিও দেশটিতে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে, তবুও দুর্নীতি এবং সংঘাতের কারণে তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।
আরো পড়ুন- বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৫৬০ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: পশ্চিম আফ্রিকা।
নাইজার সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত এবং অত্যন্ত শুষ্ক অঞ্চল হওয়ায় কৃষির জন্য খুব কম উর্বর জমি রয়েছে। দেশটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এবং তাদের জীবিকা প্রধানত পশুপালন এবং কৃষির উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার নিম্নমান এবং অশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার দুর্বল অবস্থা এবং জন্মহার বৃদ্ধির কারণে নাইজারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৬৫০ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: পশ্চিম আফ্রিকা।
লাইবেরিয়া দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশটির অর্থনীতি মূলত কৃষি, বিশেষ করে রাবার এবং কাঠের উপর নির্ভরশীল। তবে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, শিক্ষা এবং অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। দুর্নীতি এবং বেকারত্ব দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান বাধা।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৭৯০ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে।
মাদাগাস্কার পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ এবং এর অর্থনীতি প্রধানত কৃষির উপর নির্ভরশীল। চাষাবাদে দক্ষতার অভাব, বন্যা এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটির অর্থনৈতিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। দেশের বেশিরভাগ জনগণ অপুষ্টিতে ভোগে এবং স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগও অত্যন্ত সীমিত।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৫৬২ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: মধ্য আফ্রিকা।
কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ, তবে দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতি দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এবং স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। দেশটির খনিজ সম্পদ ঠিকমতো কাজে লাগানো গেলে কঙ্গো আরও উন্নত হতে পারতো।
মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) মাথাপিছু: প্রায় ৫০০ মার্কিন ডলার।
অবস্থান: দক্ষিণ এশিয়া।
দীর্ঘদিনের যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আফগানিস্তান পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির অর্থনীতি প্রধানত কৃষির উপর নির্ভরশীল, কিন্তু যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল এবং দুর্নীতির কারণে আর্থিক সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না।
উপরোক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো প্রধানত অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, এবং দুর্বল অবকাঠামো কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এসব দেশের বেশিরভাগ জনগণ অপুষ্টিতে ভোগে, শিশুমৃত্যুর হার বেশি, এবং শিক্ষার হার অনেক কম। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং উন্নত দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোর জন্য নানা ধরনের সহায়তা প্রদান করে, তবে অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে সেই সহায়তার সঠিক ব্যবহার প্রায়ই সম্ভব হয় না।
বিশ্বের দরিদ্রতম ১০টি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত দুর্বল হলেও, যথাযথ পরিকল্পনা এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। দক্ষ নেতৃত্ব, উন্নত অবকাঠামো, এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে এই দেশগুলোতে দারিদ্র্য মোকাবিলা করা সম্ভব।
Leave a Reply