আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ন
শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত শনিবার বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল এর ঘোষণা দেয়। এটি অনেকের জন্য একটি অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ হিসেবে এসেছে, বিশেষ করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষানুরাগীদের জন্য। মূলত, সমন্বয় কমিটির দুটি সদস্যকে নিয়ে কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠন আপত্তি তোলে, যা এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের ওপর আপত্তি তোলা হয়।
ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম, এই সদস্যদের অপসারণের দাবি জানায় এবং কমিটিতে কমপক্ষে দুজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চাপ দেয়। তারা মনে করে যে, কমিটিতে ধর্মীয় শিক্ষার দিকটি যথাযথভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাদের যুক্তি হলো, পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকতে হবে, যা শিশুদের নৈতিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।
বিতর্কিত হওয়ার কারন সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন.…… ঢাবির ধর্মবিদ্বেষী দুই শিক্ষককে অবিলম্বে অপসারণের দাবি
সরকারের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তকে প্রয়োজনীয় এবং পরিস্থিতির দাবি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে অনেকে মনে করেন, এটি মূলত সরকারের ওপর চাপের প্রতিক্রিয়া। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে কমিটির সদস্য পরিবর্তন এবং শেষে কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা সরকারের স্বাধীন নীতি-নির্ধারণী ক্ষমতার উপর প্রশ্ন তুলেছে।
সমালোচকরা দাবি করছেন, এই সিদ্ধান্ত সরকারের দুর্বলতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষতিসাধন করছে। শিক্ষা যেমন একটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ খাত, সেখানে ধর্মভিত্তিক চাপে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া যথাযথ নয় বলে তারা মনে করেন। শিক্ষা নীতিমালা এবং পাঠ্যপুস্তক তৈরি একটি বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুনিষ্ঠ প্রক্রিয়া হওয়া উচিত, যেখানে সমাজের সকল স্তরের মতামত গ্রহণযোগ্য হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া হতে হবে প্রমাণভিত্তিক এবং শিক্ষাবিদদের দ্বারা পরিচালিত।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ ধর্মভিত্তিক বেশ কয়েকটি দল এই সিদ্ধান্তকে তাদের জয় হিসেবে দেখছে। তাদের দাবি, সমন্বয় কমিটিতে আলেমদের অন্তর্ভুক্তি পাঠ্যপুস্তককে ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলবে। তারা মনে করে, আলেমরা ধর্মীয় শিক্ষার গভীরতা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন এবং তাদের অন্তর্ভুক্তি শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও নৈতিকভাবে সুশৃঙ্খল করবে।
তাদের যুক্তি হলো, বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা পেতে চান। ধর্মীয় শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি তাদের।
পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন একটি চলমান প্রক্রিয়া যা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রমকে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যবহারিক করতে পাঠ্যপুস্তকে সময়োপযোগী পরিবর্তন আনা দরকার। তবে এই পরিবর্তনগুলোকে অবশ্যই শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে করা উচিত।
অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন, পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি এবং অন্যান্য বিষয়গুলোর যথাযথ প্রতিফলন থাকা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে সফলভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা যেন শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত না করে।
সমন্বয় কমিটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার মান এবং শিক্ষার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ধরনের পদক্ষেপ শিক্ষা নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে তুলতে পারে, যেখানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চাপ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করতে পারে।
শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি প্রজন্মকে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যবোধ প্রদান করা, যাতে তারা সমাজের জন্য উপযোগী নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। তবে যখন এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর চাপ বেশি হয়ে যায়, তখন শিক্ষার মান কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, পাঠ্যপুস্তক সংশোধন একটি বিশেষায়িত কাজ, যা শিক্ষাবিদদের হাতে থাকা উচিত, এবং এর মধ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চাপ মেশানো হলে তা শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস করতে পারে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত এবং সকল পক্ষের অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া। সরকারের উচিত ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সাথে একটি খোলামেলা আলোচনা শুরু করা, যেখানে তারা তাদের দাবি ও উদ্বেগগুলো পেশ করতে পারবে। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রমাণভিত্তিক নীতিমালা অনুসরণ করা এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিক্ষা নীতি প্রণয়নের জন্য ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের সংমিশ্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে। তবে এটি যেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য এবং গুণগত মানকে প্রভাবিত না করে, তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের সময় শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ, সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা উচিত। একই সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার দিকে নজর রাখা দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। তবে এটি করতে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় চাপের কাছে নতি স্বীকার করা উচিত নয়। সরকারকে অবশ্যই শিক্ষাবিদদের পরামর্শের ভিত্তিতে শিক্ষার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বজায় থাকে এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে।
Leave a Reply