আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪০ পূর্বাহ্ন
শান্তিতে নোবেলজয়ী নিহন হিদানকায়ো, একটি বিশেষ সংগঠন যা ১৯৫৬ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা হামলার পর প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষদের দ্বারা গঠিত হয়। তাদের মিশন পরমাণু অস্ত্রের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বকে সচেতন করা এবং পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে অবদান রাখা। এই সংগঠনটি কয়েক দশক ধরে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে চলেছে এবং তাদের প্রচেষ্টা আজ বিশ্বের কাছে একটি মূল্যবান বার্তা বহন করছে।
১৯৪৫ সালের আগস্টে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, যুক্তরাষ্ট্র জাপানের দুটি শহর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আণবিক বোমা হামলা চালায়। এই বোমা হামলার ফলে সরাসরি এবং বিকিরণের কারণে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। হিরোশিমায় প্রথম বোমা “লিটল বয়” ৬ আগস্টে ফেলা হয় এবং নাগাসাকিতে “ফ্যাট ম্যান” ৯ আগস্টে ফেলা হয়। এই হামলার ফলে দুই শহরের শত শত মানুষ মুহূর্তের মধ্যে মারা যায় এবং অসংখ্য মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তবে সেসময় আহত ব্যক্তিদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।
হিবাকুশা বলতে সেইসব মানুষকে বোঝায় যারা আণবিক বোমা হামলার সময় বেঁচে ছিলেন এবং হামলার বিকিরণ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। অনেকেই তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণে পরবর্তী সময়ে মারা যান, আবার যারা বেঁচে ছিলেন তাদের জীবনজুড়ে শারীরিক জটিলতা ও মানসিক ট্রমার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই হিবাকুশারা পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছেন। নিহন হিদানকায়ো তাদের মধ্যে অন্যতম এবং সংগঠনের মাধ্যমে হিবাকুশারা তাদের কষ্ট ও অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন।
১৯৫৬ সালে গঠিত নিহন হিদানকায়ো সংগঠনটি মূলত হিরোশিমা ও নাগাসাকির হিবাকুশাদের নিয়ে গঠিত হয়। এই সংগঠনের মিশন ছিল পরমাণু অস্ত্রের বিপদ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের জন্য প্রচার চালানো। তাদের প্রচেষ্টার ফলে বিশ্বের বহু দেশে পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও জোরদার হয়েছে।
আরো জানুন… গ্রামীণ ব্যাংক ও আস–সুন্নাহ ফাউন্ডেশনকে পাঁচ বছরের জন্য আয়করমুক্ত সুবিধা প্রদান
বিশ্বে প্রথমবারের মতো পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার পর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশ পরমাণু অস্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। তবুও, ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়। এ কারণে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের আহ্বান সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। নিহন হিদানকায়োর মতো সংগঠনগুলো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন হয়েছে এবং অনেক দেশ পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত ছিল—পশ্চিমা শিবির এবং পূর্ব ইউরোপীয় শিবির। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকির ভুক্তভোগীদের কষ্ট সম্পর্কে কথা বলার সময় বিশ্ববাসী বিভক্ত ছিল। মার্কিন মিডিয়া ও নেতারা বোমা হামলার যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু অস্ত্রের বিলুপ্তির জন্য আহ্বান জানালেও তারাও তাদের অস্ত্রভাণ্ডার বাড়াতে থাকে। এর ফলে পরমাণু অস্ত্রের বিরোধিতা এবং এর নিষিদ্ধকরণের দাবি সেভাবে সামনে আসতে পারেনি।
যদিও সরকার এবং বড় আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বোমা হামলার কষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি প্রকাশ্যে না আনতে চেয়েছিল, কিন্তু হিবাকুশারা বসে থাকেননি। তারা বিশ্বজুড়ে নিজেদের দুর্দশা তুলে ধরতে শুরু করেন। তাদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ধীরে ধীরে পশ্চিমা বিশ্বেও পরমাণু অস্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০-এর দশক থেকে হিবাকুশারা বিভিন্ন দেশ সফর করতে শুরু করেন এবং তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে থাকেন। এর ফলে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার জন্য জনমত গড়ে তুলতে তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
নিহন হিদানকায়ো শুধু পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার আন্দোলনের প্রচারই করেনি, বরং জাপানের হিবাকুশাদের জন্য চিকিৎসাসুবিধা বাড়ানোর জন্যও কাজ করেছে। তাদের প্রচেষ্টার ফলে জাপান সরকার হিবাকুশাদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে। তবে হিবাকুশাদের প্রতি জাপানি সমাজের একটি নেতিবাচক মনোভাবও ছিল, যা ধীরে ধীরে কেটে গিয়েছে। হিবাকুশাদের অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্বে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার আন্দোলন এক ধাপ এগিয়ে যায়।
২০২৪ সালে নিহন হিদানকায়োকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে, যা তাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এই পুরস্কার কেবল তাদের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিয়েই থেমে থাকেনি, বরং তা বিশ্বব্যাপী পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে।
নিহন হিদানকায়ো বিশ্বাস করে যে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। তাদের লক্ষ্য হল পরমাণু অস্ত্র মুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলা এবং এই লক্ষ্যে তরুণদের সহযোগিতা করা। বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সম্পর্কে সচেতন করতে নিহন হিদানকায়ো বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে।
নিহন হিদানকায়ো তাদের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের আন্দোলনে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের প্রচেষ্টা এবং আত্মত্যাগের ফলস্বরূপ আজ বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রের বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের নোবেল শান্তি পুরস্কার কেবল তাদের কাজের স্বীকৃতি নয়, বরং বিশ্বব্যাপী শান্তি ও পরমাণু অস্ত্রমুক্ত একটি পৃথিবীর আহ্বান।
নিহন হিদানকায়োর কাজ আজও চলমান এবং তাদের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন থেমে থাকবে না।
Leave a Reply