আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১১ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশে নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূচনা হয়েছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক তুঙ্গে। কেউ বর্তমান আসনভিত্তিক পদ্ধতি বজায় রাখতে চাইছেন, আবার কেউ চাইছেন সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা, যেখানে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন নির্ধারিত হয়।
বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায়, যাকে “ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট” পদ্ধতি বলা হয়, একটি আসনে সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থী বিজয়ী হন। তবে এতে অনেক সময় দেখা যায় যে, বিজয়ী প্রার্থী আসলে বেশিরভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো নির্বাচনী আসনে মোট এক লাখ ভোটার থাকে এবং একজন প্রার্থী ৪০ হাজার ভোট পান, কিন্তু অন্য দুই প্রার্থী ২৫ এবং ৩৫ হাজার ভোট পান, তবে যৌথভাবে তাদের ৬০ হাজার ভোট থাকলেও তারা কোনো আসন পান না। অর্থাৎ, এখানে অধিকাংশ ভোটারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না।
সম্প্রতি “রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনী” শীর্ষক একটি ভার্চ্যুয়াল সেমিনারে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। এখানে বিএনপি, সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন এবং গণ অধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে বিএনপি ছাড়া অন্যান্য দলগুলো আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রস্তাবনায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছে। বিএনপি অবশ্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব তুলে ধরেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলামের মতে, “সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। যেহেতু এই পদ্ধতিতে ভোটাররা দলীয় প্রতীকে ভোট দেন এবং প্রার্থী ভিত্তিক নির্বাচন হয় না, তাই কালো টাকা, মনোনয়ন বাণিজ্য এবং ভোট কেন্দ্রে সহিংসতার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।”
অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদের মতে, “বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় যারা ক্ষমতায় আসে, তারা যা খুশি তাই করতে পারে এবং স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে এই ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ থাকে না, কারণ এককভাবে কোনো দল ৫১ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ফলে, একাধিক দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।”
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “আমার নির্বাচনী এলাকায় ৬২ হাজার ভোট পেয়ে আমি পরাজিত হয়েছিলাম। বিজয়ী প্রার্থী মাত্র কয়েক হাজার বেশি ভোট পেয়েছিল। এতে করে বাকি ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে এমনটা হতো না।”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন অবশ্য এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে বলেন, “আসলে ভোটাররা প্রার্থী দেখতে চায়। তারা নির্দিষ্ট প্রার্থী এবং দলের প্রতি তাদের সমর্থন প্রদর্শন করতে চায়। আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের চেয়ে দলগুলোর প্রতীক বেশি গুরুত্ব পায়, যা ভোটারদের ইচ্ছাকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে না।”
তিনি আরও বলেন, “আনুপাতিক ব্যবস্থায় মনোনয়ন বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, কারণ দলগুলো যোগ্য প্রার্থীর পরিবর্তে কেবল প্রতীকের ভিত্তিতে প্রার্থীদের মনোনীত করবে। এছাড়া, যে দলগুলো এই পদ্ধতির কথা বলছে তাদের ভোটের ভিত্তিও প্রশ্নবিদ্ধ। যদি ন্যূনতম ৫% ভোট পাওয়ার শর্ত থাকে, তাহলে অনেক দলই সেই শর্ত পূরণ করতে পারবে না।”
আরও জানুন –সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা কী?
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় আসন ভাগ হয় দলগুলোর মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী। এতে করে ভোটের মূল্য সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়, ছোট দলগুলোও প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায়, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বড় দলগুলোর একচেটিয়া প্রভাব থেকে সরে আসে। উদাহরণস্বরূপ, ৩০০টি সরাসরি আসনের সংসদে যদি কোনো দল ৫০ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে সেই দল ১৫০টি আসন পাবে। যারা ৩০ শতাংশ ভোট পাবে, তারা ৯০টি আসন পাবে, আর যারা ১০ শতাংশ ভোট পাবে তারা ৩০টি আসন পাবে। এই পদ্ধতিতে ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রবেশাধিকার থাকে, যা বর্তমান পদ্ধতিতে প্রায় অসম্ভব।
বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এবং আফ্রিকার অনেক দেশেই এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সংসদে সবার মতামত শোনা হয় এবং ক্ষমতা কেন্দ্রিকতা কমে আসে।
বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, এর জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। দ্বিতীয়ত, বড় দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে, কারণ বর্তমান পদ্ধতিতে তাদের এককভাবে বেশি আসন পাওয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়াও, এই পদ্ধতিতে প্রার্থীদের স্বতন্ত্র পরিচিতি কমে যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তে ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে। তবে, এই পদ্ধতি চালু করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনগত পরিবর্তন এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যদি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণ এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়, তবে এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
সংবিধান সংশোধন এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে এই পরিবর্তন আনা সম্ভব, তবে এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
Leave a Reply