আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ন
নিকারাগুয়া, মধ্য আমেরিকার ছোট্ট একটি দেশ, সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিয়েছে। শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, নিকারাগুয়ার সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয় এবং ইসরায়েলকে ‘ফ্যাসিস্ট’ ও ‘গণহত্যাকারী’ হিসেবে অভিহিত করেছে। গাজার বর্তমান যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওর্তেগার নেতৃত্বাধীন সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
গাজার বর্তমান যুদ্ধ এবং ইসরায়েলের ব্যাপক সামরিক কার্যক্রমের প্রতি নিন্দা জানিয়ে নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওর্তেগার স্ত্রী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট রোজারিও মুরিলো ঘোষণা করেন যে, নিকারাগুয়ার কংগ্রেস ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করেছে। এই প্রস্তাবের মূলে রয়েছে ইসরায়েলের গাজার উপর ‘নির্বিচার’ হামলা। নিকারাগুয়ার সরকার উল্লেখ করে যে, ইসরায়েলের হামলা কেবল গাজা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, বরং লেবাননেও ছড়িয়ে পড়েছে, যা পুরো অঞ্চলে বিপদজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
নিকারাগুয়ার সরকার ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘ফ্যাসিস্ট’ এবং ‘গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যা একটি কঠোর ভাষা। এই ধরনের ভাষা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সাধারণত বিরল, এবং এটি এই সংকটের গুরুত্ব ও জটিলতা বোঝায়। ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দেশ এবং প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবাদ এবং নিন্দা এসেছে, তবে নিকারাগুয়ার এই পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
নিকারাগুয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক সবসময়ই অস্থির ছিল। এটি প্রথমবার নয় যে নিকারাগুয়া ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ১৯৭৯ সালে স্যান্ডিনিস্তা বিপ্লবের পরে এবং ১৯৮২ সালে ওর্তেগার নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। এরপরে ২০১০ সালে আবারও সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। তবে ২০১২ সালে কিছু উন্নতি হলেও ইসরায়েল ও নিকারাগুয়ার সম্পর্ক কখনোই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এই সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত আবারও সেই পুরোনো উত্তেজনার পুনরাবৃত্তি করে।
আরও জানুন –টাটা ট্রাস্টে নতুন চেয়ারম্যান নোয়েল নাভাল টাটা
গাজার যুদ্ধ একাধিক কারণে উত্তেজনাপূর্ণ। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং মানবিক পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলতর হচ্ছে। ইসরায়েলের সামরিক শক্তি এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের মধ্যে সংঘর্ষটি বহু দশক ধরে চলমান। তবে সাম্প্রতিক হামাসের আক্রমণ এবং ইসরায়েলের পাল্টা প্রতিক্রিয়া এই সংঘাতকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে।
গাজার মানুষদের উপর ইসরায়েলের নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। নিকারাগুয়া এই প্রতিবাদের অন্যতম উদাহরণ হয়ে উঠেছে, যারা নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
নিকারাগুয়ার এই সিদ্ধান্ত তাদের বৈশ্বিক অবস্থানকে আরও মানবিক করে তুলতে পারে। তারা তাদের সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে গাজার নিরীহ জনগণের প্রতি সহানুভূতি এবং তাদের মানবাধিকার রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। নিকারাগুয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট রোজারিও মুরিলো বলেন, ‘‘আমরা ইসরায়েলের এই ধরনের নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়নের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি না। এটি মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ এবং আমরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি।’’ এই অবস্থান নিকারাগুয়ার আন্তর্জাতিক সুনামকে এক ধরনের নৈতিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যা মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রতীক।
নিকারাগুয়ার এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা মানে তাদের সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক ইতোমধ্যেই চাপে আছে, কারণ বিভিন্ন আরব ও মুসলিম দেশগুলো তাদের সমর্থন বন্ধ করেছে বা সীমিত করেছে।
নিকারাগুয়ার এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সমাজে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও বড় প্রতিবাদ সৃষ্টির পথে একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলোও একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। যদিও অনেক পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, তবে নিকারাগুয়ার মতো দেশগুলো নিজেদের অবস্থান থেকে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলছে।
নিকারাগুয়ার এই পদক্ষেপের পর ইসরায়েল এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ইসরায়েলের নীতিতে এমন প্রতিক্রিয়া একরকমের ‘অপ্রত্যাশিত’ ছিল না, কারণ তারা ইতোমধ্যেই অন্যান্য অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের নিন্দা এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এই ধরনের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতাকে কখনোই খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, কারণ তাদের মিত্র দেশগুলো তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে নিকারাগুয়ার এই পদক্ষেপ ইসরায়েলের বৈশ্বিক অবস্থানে সামান্য হলেও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
নিকারাগুয়ার এই পদক্ষেপ তাদের ভবিষ্যৎ কূটনীতিতে কিছু চ্যালেঞ্জ আনতে পারে। তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছে তা তাদের অন্যান্য মিত্র দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি হতে পারে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। তবে নিকারাগুয়ার জন্য এটি সম্ভব যে তারা নিজেদের মিত্র দেশগুলোকে সাথে রেখে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অবস্থান করবে।
নিকারাগুয়ার জনগণের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। গাজার যুদ্ধ এবং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে বিশ্বব্যাপী নিন্দা জানানো হচ্ছে। নিকারাগুয়ার জনগণ তাদের সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে এবং মানবাধিকারের পক্ষে তাদের দেশের অবস্থানকে ইতিবাচকভাবে দেখছে।
নিকারাগুয়ার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এই সিদ্ধান্ত একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ। এটি মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকার মধ্যে একটি নতুন ধরণের সম্পর্কের সূচনা করতে পারে। মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক সংহতি নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের জন্য এই পদক্ষেপ একটি উদাহরণ হতে পারে। এটি ইসরায়েলের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে পারে, যা পরবর্তীতে গাজা এবং পুরো অঞ্চলে শান্তি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হতে পারে।
নিকারাগুয়ার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এই ঘোষণা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি দেখায় যে, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে একটি দেশ সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারে। নিকারাগুয়ার মতো একটি ছোট দেশও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিতে প্রস্তুত। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এই পদক্ষেপ শুধু তাদের নিজেদের দেশের জন্য নয়, বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্যও একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ।
Leave a Reply