মিরপুরে সাকিব ছাড়া প্রথম টেস্টে বাংলাদেশকে নিয়ে আলো ছড়ালেন তাইজুল ইসলাম
মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সোমবার (২১ অক্টোবর) সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ দলের অন্যতম বড় তারকা সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই খেলতে নেমেছে টাইগাররা। সাকিবের অনুপস্থিতিতে ভক্তরা আশা করছিলেন, মেহেদী হাসান মিরাজ তার শূন্যতা পূরণ করবেন। তবে দিন শেষে সবাইকে চমক দেখালেন বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাঁচ উইকেট নিয়ে তাইজুল তার ১৩তম পাঁচ উইকেট শিকার করে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপকে চাপে ফেলেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলাদেশের দ্রুততম ২০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন, সাকিব আল হাসানের রেকর্ডকেও পেছনে ফেলে।
তাইজুল ইসলামের রেকর্ড-ব্রেকিং পারফরম্যান্স
তাইজুলের অসাধারণ পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল তার ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন, “অভিনন্দন তাইজুল ইসলাম! ২০০ টেস্ট উইকেট মানে বাংলাদেশের বাস্তবতায় দারুণ এক অর্জন। ৪৮ টেস্ট খেলে ২০০ উইকেট নেওয়া মানে আরও বড় অর্জন।”
তামিম তার পোস্টে আরও উল্লেখ করেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে যথেষ্ট গুরুত্ব ও প্রাপ্য সম্মান সে সবসময় পায় না। ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করেও নায়কের মর্যাদা সেভাবে অনেক সময় পায় না। তবু নিজের কাজটুকু করে গেছে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।” তামিমের মতে, বিশ্ব ক্রিকেটে বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে অন্যতম সেরা এই বোলার আরও বেশি পরিচিতি পেতেন, যদি তিনি কোনো বড় দলের খেলোয়াড় হতেন।
প্রথম দিনের খেলায় বাংলাদেশ বিপাকে, কিন্তু তাইজুলের উজ্জ্বলতা
মিরপুরে প্রথম টেস্টের প্রথম দিনেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশ দল মাত্র ১০৬ রানে গুটিয়ে যায়। প্রোটিয়া বোলারদের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অসহায় হয়ে পড়েন। বিশেষ করে উইয়ান মুলদার ও কাগিসো রাবাদার বোলিং তোপে মাত্র ২৬.১ ওভারে ৬০ রানে ৬ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। এরপর থেকে বাংলাদেশ দল কিছুটা স্থিরতা ফিরে পেলেও বাকি চার উইকেটও দ্রুত হারিয়ে মাত্র ১০৬ রানে অলআউট হয়ে যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে মুলদার, রাবাদা ও কেশব মহারাজ তিনটি করে উইকেট তুলে নেন, আর ডেইন পিড নেন একটি উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার এই ভয়ানক বোলিং আক্রমণ বাংলাদেশ দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
আরো পড়ুন- মিরপুর টেস্টে ব্যাটারদের ব্যর্থতার দিনে আশার আলো দেখাচ্ছেন তাইজুল
দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে তাইজুলের দাপট
বাংলাদেশের পেসার হাসান মাহমুদ দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের শুরুতেই আঘাত হানেন। প্রোটিয়া ওপেনার এইডেন মার্করামকে (৭ বলে ৬) বোল্ড করে দলীয় ৯ রানে প্রথম উইকেট তুলে নেন হাসান। এরপর টনি ডি জর্জি ও ত্রিস্টান স্টাবস মিলে ৪১ রানের পার্টনারশিপ গড়ে দলের স্থিতি ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন।
কিন্তু সেই জুটি ভেঙে দেন বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম। তার বলের স্লিপে সাদমান ইসলামের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে ২৭ বলে ২৩ রান করে স্টাবস সাজঘরে ফেরত যান।
এরপর ডেভিড বেডিংহামকেও উইকেটরক্ষক লিটন দাসের হাতে ক্যাচ বানিয়ে তাইজুল দক্ষিণ আফ্রিকার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট শিকার করেন। তৃতীয় সেশনের শুরুতেই তাইজুলের আরও দুটি উইকেট পেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা চাপে পড়ে। এই কীর্তির ফলে প্রোটিয়ারা ৭২ রানে তৃতীয় উইকেট হারায়।
তাইজুল তার স্পিনের জাদু দেখিয়ে টনি ডি জর্জিকে ৭০ বলে ৩০ রানে ফিরিয়ে দেন। এরপর নতুন ব্যাটার ম্যাথিউ ব্রিটজকেও মাত্র ৪ বলের মধ্যে বোল্ড করেন তিনি। এরপর রায়ান রিকেলটনকেও ৪৯ বলে ২৭ রানে ফিরিয়ে দিয়ে প্রোটিয়াদের ষষ্ঠ উইকেট তুলে নেন। তাইজুলের এই ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে দক্ষিণ আফ্রিকা চাপে পড়ে যায়।
তাইজুল ইসলামের অর্জন ও তামিমের প্রশংসা
তাইজুলের অসাধারণ বোলিং পারফরম্যান্সের জন্য তামিম ইকবাল যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনই তিনি এই বাঁহাতি স্পিনারকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অমূল্য সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তামিম তার ভেরিফাইড ফেসবুকে আরও লিখেছেন, “তার পরিসংখ্যান বলে, গত ১০ বছরে বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা স্পিনারদের একজন সে। তার পারফরম্যান্স, একাগ্রতা ও নিবেদন বলে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সে অমূল্য এক সম্পদ।”
তাইজুলের স্পিনার হিসেবে ধারাবাহিক সাফল্য এবং তার শৃঙ্খলিত পারফরম্যান্স তাকে দেশের অন্যতম সেরা বোলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তামিমের মতে, বিশ্ব ক্রিকেটে যদি তাইজুলের মতো বোলার অন্য কোনো বড় দলের অংশ হতেন, তাহলে তাকে নিয়ে আলোচনা আরও বেশি হতো।
বাংলাদেশ দলের চ্যালেঞ্জ এবং তাইজুলের ভূমিকা
প্রথম টেস্টের প্রথম দিনেই মিরপুরে প্রোটিয়া বোলারদের সামনে বাংলাদেশ ব্যাটিং অর্ডার ভেঙে পড়লেও, তাইজুল ইসলামের পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছে। তাইজুলের এই অনন্য অর্জন বাংলাদেশ দলকে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের প্রথম ইনিংসে ১৪০ রান করেছে, এবং তাদের ৩৪ রানের লিড রয়েছে। তাইজুলের বোলিং যদি আরও ধারাবাহিকতা বজায় রাখে এবং অন্যান্য বোলাররা তাকে সমর্থন করতে পারে, তবে বাংলাদেশ এই ম্যাচে ফিরে আসতে পারে।
বাংলাদেশ দলের জন্য এই ম্যাচটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতি, দুর্বল ব্যাটিং লাইনআপ এবং চাপের মুখে কিভাবে বাংলাদেশ এই ম্যাচে লড়াই করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে তাইজুলের এই রেকর্ড-ব্রেকিং পারফরম্যান্স বাংলাদেশ দলের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক হতে পারে এবং তাকে দলের মূল ভরসা হিসেবে ধরা যেতে পারে।
তাইজুল ইসলামের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
তাইজুল ইসলাম তার ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য এনে দিয়েছেন। তার অসাধারণ পারফরম্যান্স প্রমাণ করে যে তিনি বিশ্বমানের একজন স্পিনার। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার এই ধারাবাহিকতা এবং প্রতিভা জাতীয় দলের জন্য অমূল্য সম্পদ। তামিম ইকবালের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের কাছে তাইজুলের প্রশংসা এবং তার পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন প্রমাণ করে যে তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
এখন তাইজুলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং দলের জন্য প্রতিনিয়ত অবদান রাখা। যদি তিনি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন, তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে তার নাম সর্বদা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
তাইজুল ইসলামের ২০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তার অসাধারণ পারফরম্যান্স বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে তার ভূমিকা এবং তার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা আশা করছেন, তাইজুল তার সাফল্য বজায় রেখে দেশের ক্রিকেটে আরও অনেক বড় সাফল্য এনে দেবেন।
Leave a Reply