আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ অপরাহ্ন
ডিমেনশিয়া: ভুলে যাওয়ার রোগ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ডিমেনশিয়া একটি মানসিক অসুস্থতা, যা স্মৃতিশক্তি, চিন্তা, এবং দৈনন্দিন জীবনের কাজে সমস্যা সৃষ্টি করে। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়, তবে যে কোনো বয়সে এর ঝুঁকি থাকতে পারে। এটি কোনো স্বতন্ত্র রোগ নয়, বরং একাধিক উপসর্গের সমন্বয়ে গঠিত একটি অবস্থা। ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ রূপটি হলো আলঝেইমার রোগ, তবে ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া, ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া এবং লিউই বডি ডিমেনশিয়া সহ আরও অনেক ধরণের ডিমেনশিয়া রয়েছে।
এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রাথমিকভাবে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এর প্রভাব অনেকাংশে কমানো যেতে পারে।
ডিমেনশিয়ার লক্ষণ
ডিমেনশিয়ার লক্ষণ ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং সময়ের সাথে সাথে তা বৃদ্ধি পায়। প্রাথমিক লক্ষণগুলো খুবই সূক্ষ্ম হতে পারে এবং প্রথম দিকে তা লক্ষ্য করা কঠিন হয়। কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
স্মৃতিশক্তির সমস্যা: ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো স্মৃতিশক্তির অবনতি। রোগী সাম্প্রতিক ঘটনার কথা ভুলে যায় এবং একই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞাসা করতে পারে।
সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হ্রাস: দৈনন্দিন জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে এবং পরিকল্পনা করতে অসুবিধা হয়। রোগী অনেক সময় সহজ কাজেও কনফিউশন অনুভব করতে পারে।
দৈনন্দিন কাজে অসুবিধা: কাজ বা নিয়মিত কাজ যেমন রান্না করা, গাড়ি চালানো বা অর্থ ব্যবস্থাপনা করতে সমস্যা দেখা দেয়।
সময়ের ধারণা হারানো: ডিমেনশিয়া রোগীরা সময় ও তারিখ নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারে। তারা কোন দিন বা সময় সেটা ভুলে যায় এবং কোথায় রয়েছে সে বিষয়েও বিভ্রান্তি হতে পারে।
ভাষাগত সমস্যা: রোগী কথা বলতে বা শব্দ খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়তে পারে। সহজ কথোপকথনেও সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং তারা ঠিক শব্দটি মনে করতে ব্যর্থ হয়।
কোনো কাজ সম্পূর্ণ করতে অসুবিধা: আগে পরিচিত কাজ বা ক্রিয়াকলাপ করতে অসুবিধা হয়, যেমন প্রিয় কোনো খেলার নিয়ম মনে করতে পারা বা রান্নার রেসিপি ভুলে যাওয়া।
মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন: ডিমেনশিয়া রোগীরা অনেক সময় হঠাৎ করে মেজাজ পরিবর্তন করে ফেলে। তারা হতাশ, উদ্বিগ্ন বা আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে, এমনকি নিজের কাছের মানুষদের ওপরও।
ডিমেনশিয়ার কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়
ডিমেনশিয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, তবে কিছু বিষয় রয়েছে যা এই রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। নিচে উল্লেখিত কিছু কারণ রয়েছে যা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়:
বয়স: বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে এই ঝুঁকি বেশি দেখা যায়।
জেনেটিক ফ্যাক্টর: পারিবারিক ইতিহাস থাকা ডিমেনশিয়ার একটি বড় কারণ হতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তির পরিবারের কারও ডিমেনশিয়া থাকে, তবে তার ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
স্মোকিং ও অ্যালকোহল: অতিরিক্ত ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ: উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে, কারণ এসব রোগ মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহকে প্রভাবিত করে।
ডায়েট এবং শারীরিক কার্যকলাপের অভাব: সুস্থ জীবনযাত্রার অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর ডায়েট মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে, যা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
ডিমেনশিয়ার প্রতিরোধ
যদিও ডিমেনশিয়া সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু কার্যকরী পদ্ধতি অবলম্বন করলে এর ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেনে চলা: মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলমূল, সবজি, মাছ এবং বাদাম সমৃদ্ধ ডায়েট গ্রহণ করলে মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখা যায়।
নিয়মিত ব্যায়াম: দৈনিক শারীরিক কার্যকলাপ যেমন হাঁটা, দৌড়ানো বা যোগব্যায়াম মস্তিষ্কের সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়, যা মস্তিষ্কের কোষকে কার্যকর রাখে।
মানসিক ব্যায়াম: মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে মানসিক ব্যায়াম যেমন বই পড়া, পাজল খেলা, নতুন কিছু শেখা, এবং কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া যেতে পারে।
সামাজিক সংযোগ বজায় রাখা: পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি হ্রাসে সহায়ক হতে পারে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা: ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি করতে পারে, তাই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
আরো জানুন- রক্ত সংকট ও থ্যালাসেমিয়া
ডিমেনশিয়ার চিকিৎসা
ডিমেনশিয়ার এখনও কোনো নিরাময় নেই, তবে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে যা রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করলে রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা: কিছু ওষুধ রয়েছে যা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে এবং রোগের অগ্রগতি ধীর করতে সাহায্য করতে পারে। ডোনেপেজিল, মেম্যানটিন ইত্যাদি ওষুধ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।
কগনিটিভ থেরাপি: মানসিক ব্যায়ামের মাধ্যমে রোগীর স্মৃতিশক্তি ও চিন্তা শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। এতে রোগী দৈনন্দিন জীবনের কাজ করতে সক্ষম হয় এবং তার মানসিক অবস্থা উন্নত হয়।
সাইকোথেরাপি: ডিমেনশিয়ার রোগীরা মানসিক চাপ, হতাশা ও উদ্বেগে ভুগতে পারেন। সাইকোথেরাপি রোগীর মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে।
পারিবারিক সহায়তা ও যত্ন: ডিমেনশিয়ার রোগীরা পরিবারের কাছ থেকে সর্বাধিক সহায়তা প্রয়োজন। তাদের নিয়মিত যত্ন নেওয়া, সময়মত ওষুধ খাওয়ানো এবং মানসিকভাবে সমর্থন দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে নিম্নলিখিত কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:
ধুমপান ত্যাগ কর
অ্যালকোহল খাওয়া বন্ধ করুন
শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন
সামাজিকভাবে সক্রিয় হন
আপনার মনকে ব্যস্ত এবং সক্রিয় রাখুন
ভিটামিন খাওয়ার পরিমাণ বাড়ান
উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার মতো পূর্ব থেকে বিদ্যমান মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার চিকিত্সা করুন
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো শারীরিক রোগের চিকিৎসা করুনস্বাস্থ্যকর খাবার খান
প্রতিদিন ভালো মানের এবং পরিমাণে ঘুম পান
আপনার যে কোনো শ্রবণ সমস্যা হতে পারে তার চিকিৎসা করুন
ডিমেনশিয়া নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি
ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্যরা যদি ডিমেনশিয়ার কোনো লক্ষণ লক্ষ্য করেন, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা ও সহায়তা রোগীর জীবনের গুণগত মান উন্নত করতে পারে।
ডিমেনশিয়া একটি মানসিক অবস্থা, যা স্মৃতিশক্তি এবং দৈনন্দিন কার্যকলাপে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যদিও এটি পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক ব্যায়াম এবং সঠিক ডায়েট অনুসরণ করলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়। দ্রুত নির্ণয় ও চিকিৎসা রোগীর জীবনের গুণগত মান রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
Leave a Reply