আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৭ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ নিউজ :
WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু, ভারত তথা বিশ্বের শিল্প-ব্যবসায়িক মহলে শোকের ছায়া

টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু, ভারত তথা বিশ্বের শিল্প-ব্যবসায়িক মহলে শোকের ছায়া

টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু
টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু

টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু, ভারত তথা বিশ্বের শিল্প-ব্যবসায়িক মহলে শোকের ছায়া

ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পপতি টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যুতে সমগ্র ভারত তথা বিশ্বের শিল্প-ব্যবসায়িক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বুধবার (৯ অক্টোবর) রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। টাটা গ্রুপের কর্ণধার হিসেবে বিখ্যাত রতন টাটার মৃত্যু খবরটি টুইটারের মাধ্যমে জানান আরেক নামকরা শিল্পপতি হর্ষ গোয়েঙ্কা। তার মৃত্যু নিয়ে প্রথমে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত এই দুঃসংবাদটি নিশ্চিত করা হয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল এবং সংবাদ প্রতিদিন প্রথমে খবরটি প্রচার করে।

রতন টাটার মৃত্যু এবং বিভ্রান্তি

সোমবার (৭ অক্টোবর) সকালেই রতন টাটার শারীরিক অবস্থা নিয়ে প্রথমে কিছু বিভ্রান্তি ছড়ায়, যখন গুজব রটে যে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এই গুজব অল্প সময়ের মধ্যেই উড়িয়ে দেন রতন টাটা নিজে। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে জানান যে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া খবরটি ভুল। কিন্তু বুধবার (৯ অক্টোবর) বিকেলে ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যায়, রতন টাটার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে এবং তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

অসুস্থতার কারণে ভর্তি এবং মৃত্যু

রতন টাটা কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন এবং নিয়মিত শারীরিক চেকআপের জন্য হাসপাতালে যেতেন। বুধবার সকালে শোনা যায়, রক্তচাপ হঠাৎ নেমে যাওয়ার কারণে তাকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর বিকেল নাগাদ তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয় এবং শেষ পর্যন্ত রাতে তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৮৬ বছর। দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে।

আরও জানুন –বিশ্বের দরিদ্রতম ১০টি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা

রতন টাটার অবদান এবং নেতৃত্ব

‘লবণ থেকে সফটওয়্যার’—কী নেই টাটা গ্রুপের শিল্পে। টাটা গ্রুপের অধীনে শতাধিক কোম্পানি পরিচালিত হয় এবং কর্মী সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ ৬০ হাজারেরও বেশি। এই বিশাল শিল্পগোষ্ঠীর বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে যায়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রতন টাটা। তাঁর দূরদৃষ্টি, দক্ষতা এবং অটুট মনোবল টাটা গ্রুপকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়েছে।

রতন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার উত্তরসূরি হিসেবে জে আর ডি টাটা যখন ১৯৯১ সালে রতন টাটাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন, তখন অনেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ, অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা এই পদ পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। তবে জে আর ডি টাটার এই সিদ্ধান্তকে পরে রতন টাটা প্রমাণ করেন তার অসাধারণ নেতৃত্ব গুণ দিয়ে। তার নেতৃত্বেই টাটা গ্রুপ অ্যাংলো-ডাচ ইস্পাত প্রস্তুতকারী কোম্পানি ‘কোরাস’ এবং বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভার অধিগ্রহণ করে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাকে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রচুর প্রশংসা এনে দেয়।

টাটা গ্রুপের সফলতা এবং ব্যর্থতা

টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু

রতন টাটা ছিলেন লাইসেন্সধারী পাইলট। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ২০০৭ সালে এফ-১৬ ফ্যালকন মডেলের ফাইটার জেট চালান

রতন টাটা যখন টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হন, তখন কোম্পানির বিভিন্ন খাতে ব্যাপক বিস্তার ঘটে। ২০০০ সালে টাটা গ্রুপ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা কোম্পানি টেটলির অধিগ্রহণ করে। এ ছাড়া অন্যান্য সাফল্যের মধ্যে অন্যতম ছিল রেডিও, টেলিভিশন এবং টেক্সটাইল ব্যবসায় প্রবেশ করা। তবে রতন টাটার নেতৃত্বে কিছু ব্যর্থতাও ছিল। যেমন, টেলিকম খাতের ক্ষেত্রে টাটা গ্রুপ তেমন সফলতা লাভ করতে পারেনি এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

২০০৯ সালে রতন টাটার উদ্যোগে তৈরি ন্যানো গাড়ি প্রকল্পও আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ১ লাখ রুপির গাড়ি মধ্যবিত্তের জন্য আনার এই উদ্যোগটি তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি এবং তিনি নিজে এই উদ্যোগকে নিজের জীবনের অন্যতম বড় ভুল হিসেবে স্বীকার করেছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন এবং দানশীলতা

টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু

বিভিন্ন সময় রতন টাটাকে খেলতে দেখা যেত কুকুরদের সঙ্গে। রতন টাটার ইনস্টাগ্রামে তাঁর চেয়ে কুকুরের ছবির সংখ্যাই বেশি

রতন টাটা একজন অসাধারণ দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল খুবই সাধারণ এবং নম্রতাপূর্ণ। পশুপাখি, বিশেষত কুকুরের প্রতি তার বিশেষ ভালোবাসা ছিল। তার ধীরস্থির ও প্রজ্ঞাময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ তাকে সব মহলেই সমাদৃত করেছে। জীবনে কখনো বিয়ে করেননি রতন টাটা। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় বিয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু কন্যার বাবার আপত্তির কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।

রতন টাটা যেমন তার ব্যবসায়ী জীবনে সফল ছিলেন, তেমনি দানশীলতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও তিনি সমানভাবে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি টাটা গ্রুপের মাধ্যমেই বিশাল অংকের অর্থ দান করেছেন সমাজের কল্যাণে। পিটার ক্যাসির লেখা ‘দ্য স্টোরি অব টাটা’ বইয়ে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর নীতির বিষয়ে বলা হয়েছে, “পুঁজিবাদকে পরোপকারের সঙ্গে যুক্ত করে এমনভাবে ব্যবসা করাই তাদের উদ্দেশ্য, যাতে অন্যদের জীবনমান আরও ভালো হয়।”

রতন টাটার শৈশব ও শিক্ষা জীবন

টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটার মৃত্যু

মা–বাবার বিচ্ছেদের পর থেকে রতন টাটা ও তাঁর ছোট ভাই জিমি টাটা বড় হন তাঁর দাদির কাছে

রতন নেভাল টাটার জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ে। তিনি পারসি পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার বাবা নেভাল টাটা এবং মা সুনি টাটা ছিলেন ভারতীয় সমাজের উচ্চশিক্ষিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তার পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ শাসনামলে ইরান থেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রতনের মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে তিনি তার ঠাকুমার কাছে বড় হন। ঠাকুমা লেডি নাভাজ বাই তাকে অনেক ভালোবাসতেন এবং তার কাছেই বড় হয়ে ওঠেন রতন টাটা।

রতন টাটার প্রাথমিক শিক্ষা মুম্বাইয়ের ক্যাম্পিয়ন ও ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুলে। স্কুল জীবনে তিনি বেশ লাজুক প্রকৃতির ছিলেন এবং মানুষের সঙ্গে কথা বলতে সংকোচ বোধ করতেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। সাত বছর যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় তিনি গাড়ি এবং উড়োজাহাজ চালানো শিখেন। যুক্তরাষ্ট্র তার এতটাই প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে তিনি সেখানেই স্থায়ী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঠাকুমার অসুস্থতার কারণে তাকে ভারতে ফিরে আসতে হয়।

টাটা গ্রুপে যোগদান এবং ক্যারিয়ার

রতন টাটা ১৯৬২ সালে ভারতে ফিরে এসে জে আর ডি টাটার নির্দেশে টাটা গ্রুপে যোগ দেন। প্রথমে তিনি ঝাড়খন্ডের জামশেদপুরে টাটা স্টিলের কারখানায় হাতে-কলমে কাজ শিখতে শুরু করেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে তিনি কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগে কাজের সুযোগ পান এবং পরে টাটা গ্রুপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের দায়িত্ব নেন।

১৯৯১ সালে জে আর ডি টাটা তাকে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দেন। রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ বিশ্ববাজারে তার স্থান দৃঢ় করে এবং আন্তর্জাতিক মানের কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

রতন টাটা ভারতের উন্নত ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময়ই আশাবাদী ছিলেন। ২০০৯ সালে একটি স্কুলের অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “আমি এমন এক ভারত চাই, যেখানে সবাই মেধার ভিত্তিতে উন্নতির সুযোগ পাবে। আমাদের দেশের উন্নতির জন্য সম্পদের পাশাপাশি প্রয়োজন মেধার মূল্যায়ন।”

রতন টাটা তার কর্মজীবনে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আধুনিকীকরণে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। তার উত্তরাধিকার ভারতের ব্যবসা এবং শিল্প খাতকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

পোষ্ট টি শেয়ার করে দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2024 desherbulletin.Com
Developed By One Planet Web