আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩৮ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের নাট্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত নাট্যজন, নির্দেশক, অভিনেতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিন হোসেন ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর খবরটি শোকের ছায়া ফেলেছে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। ৮১ বছর বয়সে তিনি কানাডার ক্যালগেরির রকিভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর ছেলে তাসফিন হোসেন তপু। জামাল উদ্দিন হোসেনের মতো একজন গুণী মানুষের চলে যাওয়া দেশের নাট্য ও সাংস্কৃতিক জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
জামাল উদ্দিন হোসেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। তিনি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে তিনি মঞ্চে এবং টেলিভিশনে বিভিন্ন নাটকে অসামান্য অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তার অভিনীত চরিত্রগুলো সবসময়ই দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন নাট্য নির্দেশক এবং অভিনেতা, যিনি তাঁর অনন্য দক্ষতা ও মেধা দিয়ে বাংলা নাটকের জগতে নিজের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন।
তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনি শুধুমাত্র মঞ্চ নাটকেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। তবে, গত ১৫ বছর ধরে তিনি অভিনয়ে অনিয়মিত ছিলেন এবং গত ৭ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। তার মৃত্যুর খবরটি কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক মুহাম্মদ খান ও সাস্কাটুন প্রবাসী রাজনীতিবিদ বজলুর রহমান নিশ্চিত করেছেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর, জামাল উদ্দিন হোসেনের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দেয়। তখন তাকে তড়িঘড়ি করে ক্যালগেরির রকিভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। মৃত্যুর আগের কিছুদিন তিনি ছিলেন ক্যালগেরিতে তাঁর ছেলের কাছে। তাঁর ছেলে তাসফিন হোসেন তপু ক্যালগেরির মাউন্ট রয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
জামাল উদ্দিন হোসেনের নাট্যজগতে অবদান অনস্বীকার্য। তিনি তাঁর সময়ের সেরা নাট্যব্যক্তিত্বদের একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর অভিনয় দক্ষতা ও নাট্য নির্দেশনা ছিল নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা। তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মাধ্যমে যে পথ তৈরি করেছিলেন, তা আজও দেশের নাট্য জগতে আলো ছড়াচ্ছে।
তাঁর পরিচালিত এবং অভিনীত নাটকগুলোতে সবসময়ই একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা পাওয়া যেত, যা দেশ ও সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরত। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে তাঁর সৃষ্টিকর্মে তা প্রতিফলিত করতেন। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, তিনি জাতির মুক্তির সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।
জামাল উদ্দিন হোসেনের কর্মজীবন কেবল নাটকেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি দেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন। তাঁর এই অবদানের জন্য তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তিনি নাটকের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশপ্রেমকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছিলেন।
বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে তাঁর নাম শাশ্বত হয়ে থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি দেশকে যেমন রক্ষা করেছেন, তেমনি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে দেশের সাংস্কৃতিক ও শিল্পীজগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার মৃত্যুতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জামাল উদ্দিন হোসেন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় ছেলের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তাঁর ছেলে তাসফিন হোসেন তপু ও পরিবারের সদস্যরা কানাডায় তার পাশে ছিলেন।
জামাল উদ্দিন হোসেনের মৃত্যুতে তাঁর পরিবার, সহকর্মী এবং ভক্তদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর জানাজা ও দাফনের বিষয় নিয়ে এখনও পরিবার থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে, তাঁর জীবনের মতোই মৃত্যুর পরও তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্মান জানানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জামাল উদ্দিন হোসেনের মৃত্যুর খবরে নাট্যজগতের ব্যক্তিরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। অনেকেই তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রশংসা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকবার্তা দিয়েছেন। তাঁর সহকর্মীরা জানান, তিনি ছিলেন একজন অনন্য মেধাবী এবং সৃজনশীল ব্যক্তি, যার কাজ দেশের নাট্য জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল।
জামাল উদ্দিন হোসেনের অনুপস্থিতি বাংলাদেশ নাট্য জগতের জন্য এক বিশাল ক্ষতি। নাট্যব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা হিসেবে তার কাজ, সৃজনশীল চিন্তা এবং সংস্কৃতি প্রচারের অবদানের জন্য তিনি সবসময় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও কাজের মাধ্যমে তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।
জামাল উদ্দিন হোসেন শুধু নাট্যকর্মী নন, তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক। তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে। তিনি তাঁর জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন, একজন শিল্পী কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, একজন সমাজসেবীও হতে পারে, যার কাজ সমাজের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের জন্য প্রভাব ফেলে।
নতুন প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের জন্য জামাল উদ্দিন হোসেন এক অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের জীবন ও কাজ থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। নাটকের মাধ্যমে সামাজিক বার্তা পৌঁছানোর যে চেষ্টা তিনি করে গেছেন, তা ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ নাট্যাঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
জামাল উদ্দিন হোসেনের মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন, নাট্যজগৎ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারক সকলে গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর মতো গুণী মানুষদের চলে যাওয়া সবসময়ই একটি শূন্যতা তৈরি করে। তার পরিবার, সহকর্মী এবং নাট্যজগতের সকলেই আজ শোকের মধ্যে ডুবে আছেন। তবে তাঁর সৃষ্টিশীল কাজগুলো তার জীবনকে অনন্তকাল ধরে স্মরণীয় করে রাখবে।
জামাল উদ্দিন হোসেনের মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা পূরণ করা সহজ হবে না। কিন্তু তাঁর কাজ এবং তাঁর স্মৃতি আমাদের সবার মাঝে বেঁচে থাকবে।
Leave a Reply