আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৬ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ঘটনার জন্য আলোচিত হয়ে থাকা আশুলিয়ার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিরীহ জনগণের ওপর গুলি বর্ষণ এবং তারপর লাশ পোড়ানোর বীভৎস ঘটনা আজও মানুষের স্মৃতিতে জাগরুক। সম্প্রতি এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে বিবেচিত, আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তাকে বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) শাহবাগ থানায় রাখা হয়েছে।
এ ঘটনার শেকড় গাঁথা রয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে, যা ছাত্রদের ওপর পুলিশের নির্যাতন ও নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল। বিক্ষোভে সেদিন সাধারণ জনগণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও অংশ নেয়, যাদের ওপর পুলিশের গুলি, লাঠিচার্জ এবং অবশেষে গুলির মাধ্যমে ৪৬ জন নিরীহ জনতার প্রাণহানি ঘটে। প্রমাণাদিতে উঠে আসে যে, এই হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্বে ছিলেন আশুলিয়া থানার তৎকালীন ওসি এএফএম সায়েদ, যিনি ঘটনার দিন সিভিল ড্রেসে ঘটনাস্থলে ছিলেন। পরনে ছিল নীল পোলো শার্ট ও কালো ট্রাউজার, আর পকেটে ছিল ওয়্যারলেস সেট। এছাড়া তার হাতে ছিল ব্যান্ডেজ এবং তিনি চরম উত্তেজনায় একের পর এক সিগারেট খেয়েছেন।
এএফএম সায়েদকে গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) রাতে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়, যেখানে প্রাথমিকভাবে শাহবাগ থানায় তাকে রাখা হয়েছে। পুলিশের একাধিক বিশেষ দল বহুদিন ধরে সায়েদের অবস্থান নজরে রাখছিল এবং বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে অবশেষে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তিনি এতদিন গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা চারজন পুলিশ কর্মকর্তা, যাদের পদবি পরিদর্শক, উপপরিদর্শক, এবং কনস্টেবল পদে ছিল, তারা জানান যে, ওসি সায়েদই ছিলেন প্রধান নির্দেশদাতা। তাদের কথায় জানা যায়, এই হত্যাযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ তিনি নিজেই দিয়েছিলেন এবং পুলিশ বাহিনীকে মরদেহ সরানোর নির্দেশ দেন। পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মনির এবং আশুলিয়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আরাফাত উদ্দিনও পেট্রোল সংগ্রহ করে মরদেহ পোড়ানোর কাজে যুক্ত ছিলেন।
আরো পড়ুন- আগামী সোমবার ৪ নভেম্বর ফুলকোর্ট সভা ডেকেছেন প্রধান বিচারপতি
নির্যাতন ও হত্যার পর মরদেহগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলা এবং প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য পেট্রোল সংগ্রহ করা হয়েছিল। তদন্তে উঠে আসে, এসআই আরাফাত ও এএসআই মনিরের মাধ্যমে প্লাস্টিকের বোতলে পেট্রোল আনা হয়, যা ৩ ধাপে গাড়ির ওপর ছিটিয়ে মরদেহ পোড়ানো হয়। এসমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে সরাসরি ওসি সায়েদের তত্ত্বাবধানে। বিভিন্ন প্রমাণাদি ও সাক্ষীর ভিত্তিতে এসব তথ্য এখন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশের এসআই পদে যোগদানকারী এএফএম সায়েদ একাধিক স্থানে দায়িত্ব পালন করেছেন। খুলনা মহানগরের ৪ নম্বর মিয়াপাড়া মহল্লার বাসিন্দা মো. ইসমাইলের ছেলে তিনি এবং তার পুলিশ পরিচিতি নম্বর – বিপি-৮০০৬১৪৫৩৩৬।
দীর্ঘদিনের কর্মজীবনে বিভিন্ন কৌশল এবং শক্তিশালী যোগাযোগের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তার এই জঘন্য অপরাধজনক কার্যক্রম দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত হানে।
এই আন্দোলন এবং নির্যাতনের ঘটনা দেশের বিভিন্ন মহলে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একাধিক মানবাধিকার সংস্থা, শিক্ষার্থী, আইনজীবী এবং রাজনৈতিক নেতারা এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার দাবি করেন। আন্দোলনের সময় ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি ঘটনার প্রকৃত পরিস্থিতি প্রমাণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এরই ধারাবাহিকতায়, এই জঘন্য ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করা হয়।
গ্রেপ্তারের পরবর্তীতে সায়েদকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হবে, যেখানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হবে। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি এবং পুলিশি তথ্যের ভিত্তিতে ওসি সায়েদের দোষ প্রমাণ করা হবে। বিচার প্রক্রিয়ায় দেশ-বিদেশের আইন বিশেষজ্ঞরা জড়িত থাকবেন। এর ফলে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।
এএফএম সায়েদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন, এবং এই সম্পর্কের কারণে বহুদিন পর্যন্ত তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তার গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হয়নি এবং প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপে তিনি গ্রেপ্তার হন। সায়েদের এই রাজনৈতিক যোগাযোগ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তার রাজনৈতিক প্রভাব তাকে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার কাজে সহায়ক ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ঘটনার পর সারা দেশে জনগণের মাঝে ক্ষোভ ও আন্দোলন আরও উসকে দেয়। জনগণ, শিক্ষার্থী এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনের পক্ষে বহুজন তাদের মত প্রকাশ করেন। দেশের বিভিন্ন শহরে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
ওসি এএফএম সায়েদের গ্রেপ্তার দেশের বিচার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন করতে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া, এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া হলে, দেশে আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
Leave a Reply