আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪০ পূর্বাহ্ন
ইসরায়েলের উপর যে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইরান তা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের উত্তেজনা আবারও নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ইরান সম্প্রতি ইহুদিবাদী ইসরায়েলের উপর প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যেখানে তারা প্রথমবারের মতো অত্যাধুনিক ফাতাহ ১ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি আঘাত হানছে। ইরানের এই হামলা পুরো ইসরায়েলজুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তাব্যবস্থা ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত ফাতাহ ১ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের সামরিক শক্তির একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের বিশেষত্ব হলো এটি শব্দের চেয়ে ১৫ গুণ দ্রুত ছুটতে সক্ষম, যা প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সহজেই পাশ কাটাতে পারে। ইরানের সামরিক বাহিনী এই অস্ত্রটি প্রথমবারের মতো গত বছর প্রকাশ্যে নিয়ে আসে, যা মূলত আক্রমণাত্মক কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য পরিকল্পিত। ফাতাহ ১ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এটি প্রতিপক্ষের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সরাসরি আঘাত হানতে পারে।
ইরানের আধা-সরকারি গণমাধ্যম মেহর নিউজ জানিয়েছে, এই হামলায় ফাতাহ ১ ক্ষেপণাস্ত্র প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। ইরান দাবি করেছে, তাদের সামরিক ক্ষমতার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র প্রদর্শন করা হয়েছে এবং ইসরায়েলের আরও আক্রমণ হলে, তার জবাবে ইরান আরও বড় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান স্পষ্ট করে বলেছেন, ইরান এই হামলা চালাতে বাধ্য হয়েছে এবং এটি তাদের সামরিক সক্ষমতার কেবল একটি “ঝলক” মাত্র। তিনি ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছেন, ইরানের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে জড়ানো ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইরান তার স্বার্থ এবং নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য সমস্ত পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত এবং এই হামলা ছিল সেই প্রতিশ্রুতিরই বাস্তবায়ন। পেজেশকিয়ান আরও বলেন, ইসরায়েলকে ভবিষ্যতে এই ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে, অন্যথায় আরও গুরুতর প্রতিক্রিয়া তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই হামলা আত্মরক্ষার তাগিদে চালানো হয়েছে। তারা স্পষ্ট করেছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ কেবল প্রতিরোধমূলক ছিল, এবং এটি ইরানের বৈধ অধিকার। বিবৃতিতে তারা জানায়, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে মূল এলাকাগুলোতে আঘাত হানা হয়েছে, যা ইসরায়েলের সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া, আইআরজিসি পরিষ্কার করে বলেছে, এই হামলা মূলত হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহ নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ এবং আইআরজিসি’র ডেপুটি কমান্ডার আব্বাস নীলফোরুশানের শাহাদাতের বদলা হিসেবে করা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, ইসরায়েলকে শিক্ষা দিতে এবং তাদের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে এই হামলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
ইরানের এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরায়েলের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সূত্র মতে, ইসরায়েলের নিরাপত্তাব্যবস্থা ইরানের এই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে। যদিও ইসরায়েল দাবি করেছে যে, তারা বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে পেরেছে, তবে একাধিক অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক সাধারণ মানুষকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দ্রুত প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং দেশটির আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।
আরও জানুন-‘ইরানকে শীঘ্রই এর ফলাফল ভোগ করতে হবে’, নেতানিয়াহুর কড়া হুঁশিয়ারি
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে এই সাম্প্রতিক সংঘাত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলি দ্রুত এই সংঘাতের অবসান চেয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমাগত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এই ধরনের সংঘাত পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতাকে বিপদে ফেলছে।” তিনি সমস্ত পক্ষকে সহিংসতা থেকে সরে এসে আলোচনা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও এই সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেছেন, “ইসরায়েলকে এই ধরনের হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। ইরানের দাবি অনুযায়ী, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে গাজা এবং লেবাননের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে, যা ইরান এবং তার মিত্রদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতিতে, ইরান আত্মরক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে বলে দাবি করেছে।
এই হামলার ফলে ইরান ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও এই আক্রমণের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। ইরানের ফাতাহ ১ ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষমতা এবং এর অতি দ্রুতগামী হওয়ার ফলে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা সহজে প্রতিহত করতে পারেনি, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য বড় ধাক্কা।
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলমান এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের ফলে শুধু ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে নয়, বরং পুরো অঞ্চলে সহিংসতার মাত্রা বাড়তে পারে। ইতোমধ্যেই লেবানন, গাজা এবং সিরিয়ার পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থিতিশীল। এই সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত হলে তা শুধুমাত্র আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক সংঘাতের এই ধারা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উভয় পক্ষই একে অপরকে প্রতিহত করতে আগ্রহী। ইরানের ফাতাহ ১ ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার ইরানের সামরিক সক্ষমতার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সংঘাতকে শান্তিপূর্ণভাবে নিরসন করা এবং উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। তবে পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে আরও বড় সংঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
Leave a Reply