‘ইরানকে শীঘ্রই এর ফলাফল ভোগ করতে হবে’, নেতানিয়াহুর কড়া হুঁশিয়ারির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে আবারও উত্তেজনার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে, যেখানে ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। মঙ্গলবার ইরান ইসরায়েলের উপর প্রায় ২০০টি মিসাইল নিক্ষেপ করে, যা তেল আভিভসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানে। এই ঘটনার ফলে ইসরায়েলের জনগণকে দ্রুত নিরাপদ বাঙ্কারে সরিয়ে নিতে হয় এবং ইসরায়েলের আকাশ সীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ইরানের প্রতিক্রিয়া
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাঘচি জানিয়েছেন, ইরানের এই আক্রমণ জাতিসংঘের সনদের ৫১ নম্বর ধারার অধীনে আত্মরক্ষার অধিকার অনুযায়ী। তাঁর দাবি, ইসরায়েল গাজা এবং লেবাননে গণহত্যা চালাচ্ছে, এবং ইরান কেবলমাত্র তার প্রতিরোধ করছে। তিনি আরো জানান, এর আগেও ইসরায়েল ইরানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আক্রমণ চালিয়েছে। এ কারণে ইরান আত্মরক্ষার স্বার্থে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। উল্লেখ্য, লেবাননে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাচ্ছে, এবং ইরান এই সমর্থনকে কখনও অস্বীকার করেনি।
নেতানিয়াহুর জবাব
ইরানের এই আক্রমণের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ইসরায়েল কখনও বেসামরিক জনগণের উপর আক্রমণ চালায়নি; বরং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইরানের এই আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা জানিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, “ইসরায়েলের উপর আক্রমণ চালানো হলে তার চরম মূল্য দিতে হবে। ইরানকে শীঘ্রই এর ফলাফল ভোগ করতে হবে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
ইরানের আক্রমণের পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা জানান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে আছে এবং আক্রমণের জবাব দেওয়ার বিষয়ে তারা সক্রিয়ভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসও ইরানের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, “ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একটি অস্থিতিশীল ও ভয়ংকর শক্তি। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে একমত হয়ে, আমি এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাই।”
লেবাননে ইসরায়েলের অভিযান
ইসরায়েল বর্তমানে লেবাননের দক্ষিণে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ বৈরুত এবং তার আশেপাশে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ করছে। ইসরায়েলি সেনা দক্ষিণ বৈরুতের বেসামরিক মানুষদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, কারণ সেখানে হিজবুল্লাহর পরিকাঠামো রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই আক্রমণের ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় লেবাননে অন্তত ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১৫৬ জন আহত হয়েছে বলে লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
আরও জানুন-লেবাননে ইসরায়েলি হামলা ,যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা ব্যবহার: মার্কিন সিনেটরের দাবি
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই সংঘাতের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দ্রুত সংঘর্ষ বিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক আক্রমণ চলছে, যা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। সব পক্ষকেই শান্তি বজায় রাখতে হবে এবং সংঘর্ষের পথ থেকে সরে আসতে হবে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি প্রধান জসেপ বরেলও এই সংঘাতের নিন্দা করেছেন। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে লেখেন, “ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব পক্ষকে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে এগিয়ে আসা উচিত।”
মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি
মধ্যপ্রাচ্য বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা কেবল এই অঞ্চলের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে না, বরং বৈশ্বিক শান্তি রক্ষার চেষ্টাগুলোকেও বাধাগ্রস্ত করছে। এই সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সক্রিয়ভাবে এ সংঘাত নিরসনের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে।
যদিও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই আক্রমণের জবাব দেওয়ার হুমকি এসেছে, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এবং মধ্যস্থতায় এ সংঘাত আরও গুরুতর আকার ধারণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে। তবে, যদি কোনো পক্ষ শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে না চায়, তাহলে এই সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের ফলে শুধু এই দুই দেশের মধ্যেই নয়, বরং পুরো অঞ্চলজুড়ে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই লেবানন, সিরিয়া, এবং গাজার পরিস্থিতি সংকটজনক। হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতির কারণে এই সংঘাত আরও ব্যাপক আকার নিতে পারে।
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক মোড়ে নিয়ে গেছে। এই সংঘাতের ফলে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং আঞ্চলিক প্রভাব দূরদর্শী এবং কৌশলগত পদক্ষেপের প্রয়োজন। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এই সংঘাত নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে পরিস্থিতি এখনই কোন দিকে মোড় নেবে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
Leave a Reply