আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৫ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মহলে বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সাম্প্রতিক একটি তদন্তের ফলাফল। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি দাবি করেছেন, দেশ থেকে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থের একটা বড় অংশ গিয়েছে উচ্চ পদস্থ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের হাতে।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সালমান এফ রহমানের বক্তব্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে এস আলম নামক একজন ব্যবসায়ী প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এর মধ্যে অর্ধেক অর্থ নাকি শেখ রেহানা ও সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেওয়া হয়েছে। এই দাবি যদি সত্য হয়, তাহলে এটি দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এক বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে।
সালমান এফ রহমান আরও জানিয়েছেন, নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা চাপ দিতেন। এই প্রকল্পগুলো থেকে বড় অঙ্কের কমিশন আসত। তিনি দাবি করেছেন, এসব বিষয়ে শেখ হাসিনা অবগত ছিলেন, কিন্তু কখনও বাধা দেননি।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সালমান এফ রহমানের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে সাহস পাননি। শুধু অর্থ পাচারই নয়, এস আলম নাকি দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠান যেমন ইস্টার্ন রিফাইনারি ও চিনিকলও হাতিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু কেউ এ বিষয়ে মুখ খোলেনি।
সালমান এফ রহমান দাবি করেছেন, শেখ পরিবারের অতিরিক্ত লোভের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপ হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের শীর্ষস্থানীয় কিছু ব্যক্তি এসব কার্যকলাপে সহযোগিতা করেছেন। তিনি আরও জানান, অনেকে শেখ হাসিনাকে এসব বিষয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, সালমান এফ রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে তার ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি নিজের পছন্দমতো ব্যক্তিদের ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতেন। যারা তার পছন্দের ছিলেন না, তাদেরকে যোগদান করতে দেননি বা পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুনকে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি যোগদান করতে পারেননি। একইভাবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ড. জামাল উদ্দীন আহমেদকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
তদন্তকারীরা সালমান এফ রহমানকে বিভিন্ন বন্ড থেকে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা তোলার বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন। তিনি বারবার অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে এসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। বিশেষ করে ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ নামে একটি বন্ড থেকে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা তোলার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। এছাড়াও ‘সুকুক’ বন্ডের মাধ্যমে দুই হাজার ২৫০ কোটি টাকা তোলার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ আগস্ট ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে তারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।
এই ঘটনাপ্রবাহ দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। যদি এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে তা দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গুরুতর প্রশ্ন তুলবে। অন্যদিকে, এসব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, সে প্রশ্নও উঠবে।
বর্তমান সরকার এখনও পর্যন্ত এসব অভিযोগের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে বিরোধী দলগুলো এই সুযোগে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তারা দাবি করছে, এসব অভিযोগের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, এই ধরনের অভিযোগ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তারা আশা করছেন, সরকার এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে এবং জনগণকে সত্য জানাবে। অন্যদিকে, অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই ধরনের বড় অঙ্কের অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
বর্তমানে এই বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জানিয়েছে, তারা সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এই প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর ফলাফল কী হবে, তা সময়ই বলবে। তবে এটি নিঃসন্দেহে দেশের জনগণের মধ্যে বিপুল আগ্রহ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আগামী দিনগুলোতে এই বিষয়ে আরও তথ্য ও ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
Leave a Reply