আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৫ পূর্বাহ্ন
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ ছিল। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি বেশ কয়েকদিন কারফিউ জারি থাকার কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বিশাল প্রভাব পড়েছে। এসব পরিস্থিতির কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। বরং আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি অবশ্য আরও তিন গুণ বেশি; অর্থাৎ ১৫ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধীরগতির কারণে রাজস্ব আদায়ে এ বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আইএমএফ এই সময়ে রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এনবিআরও তাদের লক্ষ্য পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে, কারণ দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির ছিল।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এনবিআর ৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এনবিআর ৪৭ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেও, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এনবিআর মোট ৪২ হাজার ১০৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এই সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৫৭ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, যা অর্জিত হয়নি। এর মানে, রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এনবিআরকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রথম দুই মাসে লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতার পর, এনবিআর কর্মকর্তারা আশাবাদী যে বছরের শেষ দিকে রাজস্ব আদায়ের হার বৃদ্ধি পাবে। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সম্প্রতি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্য কমবে না এবং কর আদায় বাড়ানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও জানুন –সন্দেহভাজন সরকারি কর্মকর্তাদের নজরদারির আওতায় আনতে যাচ্ছে এনবিআর
এনবিআর সূত্র মতে, আমদানি, ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর বা মূসক) এবং আয়কর—এই তিন খাতের মধ্যে কোনোটিতেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা গেছে আয়কর খাতে। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে, জুলাই-আগস্টে এই খাতে ৭ হাজার ৪১ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ১১ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা।
আমদানি খাতেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। দুই মাসে এই খাতে ১৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১৪ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা, যা ২ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা কম। ভ্যাট খাতে আদায় হয়েছে ১৬ হাজার ২৮ কোটি টাকা, যা ২১ হাজার ১৫১ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা কম।এতে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে ।
বাংলাদেশ ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য আবেদন করে। ছয় মাস পর, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফ এই ঋণ অনুমোদন করে এবং ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত কিস্তিতে এ অর্থ প্রদান করবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ তিনটি কিস্তি পেয়েছে।
আইএমএফের সঙ্গে এই ঋণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত জড়িত রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিবছর জিডিপির দেড় শতাংশ পরিমাণ অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা এবং ২০২৭ সালের মধ্যে সব ধরনের করছাড় প্রত্যাহার করা। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর একটি কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
গত জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থির ছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে বেশ কয়েকদিন সাধারণ ছুটি ও কারফিউ জারি ছিল। অফিস, আদালত, এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রায় সবই বন্ধ ছিল, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ ছিল এই অস্থিরতা।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জানান, সাধারণত অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আদায় কিছুটা কম হয়। তবে এবারের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এনবিআরের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হয়নি। তবে তিনি মনে করেন, পরবর্তী মাসগুলোতে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে কর কর্মকর্তারা অধিক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
এনবিআর এর আগেও অনুরূপ পরিস্থিতিতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সফল হয়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করেছিল। সে সময় কর কর্মকর্তারা প্রভাবশালী মহলের চাপ ছাড়াই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। এবারও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে কর আদায় প্রক্রিয়া অধিকতর স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বছরের শেষ দিকে কর আদায়ের হার বাড়বে। এজন্য কর কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান কর কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এবারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। তাদেরকে নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হবে এবং কর আদায়ের পদ্ধতি আরও উন্নত করতে হবে।
এছাড়া, এনবিআর কর্তৃপক্ষ আশা করছে যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিক হলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে। এনবিআর কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে, বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে।
আইএমএফের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় পেতে বাংলাদেশকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা দূর করা, ব্যাংক খাতের তদারকি জোরদার করা, সুদহার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কাঠামো প্রণয়ন করা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ঝুঁকি হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
আইএমএফের পরবর্তী কিস্তির অর্থ ছাড় পাওয়ার জন্য এসব সংস্কার কার্যক্রমে অগ্রগতি দেখাতে হবে। অর্থমন্ত্রীর অধীনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো ইতোমধ্যে এসব সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে এবং তা দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এনবিআর উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, এবং কারফিউর কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছিল, যা শুল্ক-কর আদায়ে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। তবে এনবিআর কর্তৃপক্ষ আশাবাদী যে, বছরের শেষের দিকে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে।
এছাড়া, আইএমএফের সঙ্গে ঋণের শর্ত পূরণ করতে হলে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়ানোর জন্য সরকারকে নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক হবে।
Leave a Reply