আজ সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যপদ অর্জনের পথে মলডোভা এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌঁছেছে, যখন ২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গণভোটে দেশটির জনগণ ইইউতে যোগদানের পক্ষে মত প্রদান করেছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আলোচনার পর, রাশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে জটিল সম্পর্কের কারণে এই ভোটটি মলডোভার ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রোববার অনুষ্ঠিত ভোটে দেশের অর্ধেকের কিছু বেশি মানুষ ইইউ সদস্যপদের পক্ষে মত দেন, যা মলডোভার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
মলডোভা একটি ছোট দেশ হলেও পূর্ব ইউরোপের জন্য এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। রাশিয়ার সাথে দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার পর, ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর থেকে মলডোভা ক্রমেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকছে। মলডোভা নিজেকে ইউরোপের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
ইইউতে যোগদানের প্রক্রিয়াটি সহজ নয় এবং দীর্ঘ আলোচনার ফলাফলস্বরূপ এটি অর্জিত হয়। ২০২৪ সালে মলডোভা প্রথমবারের মতো ইইউ সদস্যপদ নিয়ে গণভোট আয়োজন করে। যদিও এর আগের জরিপগুলোতে ইইউতে যোগদানের পক্ষে জনমতের সমর্থন বেশি দেখা গিয়েছিল, ভোটের সময়কার পরিস্থিতি কিছুটা অনিশ্চিত ছিল।
রোববার বিকেল পর্যন্ত মলডোভায় গণভোটের ফলাফল বেশ অনিশ্চিত ছিল। প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট গণনার পর, ইইউতে যোগদানের পক্ষে সমর্থনকারী ভোটারদের সংখ্যা আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু ভোট গণনার শেষ পর্যায়ে এসে দেখা যায়, দেশের ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটার ইইউতে যোগদানের পক্ষে এবং ৪৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। এই ফলাফল দেশটির রাজনৈতিক দৃশ্যপটের জন্য একটি বড় পরিবর্তন হিসেবে ধরা যায়, কারণ মলডোভার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর এটি গভীর প্রভাব ফেলবে।
মলডোভার বৈদেশিক ভোটাররা ইইউ অন্তর্ভুক্তির পক্ষে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। বিদেশে থাকা মলডোভা নাগরিকদের ভোট গণনার পর থেকে ইইউতে যোগদানের পক্ষে থাকা ভোটের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মলডোভার বাইরে থাকা জনগণ দেশটির ভবিষ্যৎকে ইউরোপের সাথে যুক্ত দেখতে চায় এবং তারা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের দিকে আগ্রহী।
মলডোভা সরকার রাশিয়ার ওপর ভোটে হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছে। মলডোভা কর্তৃপক্ষ জানায় যে, রাশিয়া ভোট কেনাবেচার মাধ্যমে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। মলডোভার প্রেসিডেন্ট মায়া সানদু বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগও তুলেছেন। তার দাবি, রাশিয়া-ঘনিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রায় তিন লাখ ভোটারকে ঘুষ দিয়ে ইইউ অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে ভোট দিতে প্ররোচিত করেছে। এছাড়া, পলাতক মলডোভান ব্যবসায়ী ইলান শরকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি ভোটারদের অর্থ দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলে অভিযোগ।
আরও জানুন –ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাসভবনে ড্রোন হামলা
রাশিয়া মলডোভার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং তারা বলে আসছে যে, মলডোভার জনগণের সিদ্ধান্তে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি। তবে মলডোভা সরকার রাশিয়ার সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে সতর্ক রয়েছে এবং তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। রাশিয়া যদিও এই প্রক্রিয়াকে ক্ষতিকারক হিসেবে অভিহিত করছে, তবে মলডোভার জনগণ ইইউ অন্তর্ভুক্তির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে বলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মলডোভার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। দেশটির প্রায় ২৫ লাখ মানুষ কৃষিতে কাজ করেন এবং এই খাতটি তাদের আয়ের প্রধান উৎস। ইইউ অন্তর্ভুক্তির ফলে মলডোভার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের সুযোগ, উন্নত প্রযুক্তি এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতার মাধ্যমে মলডোভা আরও শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারবে। ইইউ অন্তর্ভুক্তি মলডোভার কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
তবে, ইইউ অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়াটি মসৃণ নয়। মলডোভাকে প্রথমে ইইউ-এর সাথে বিভিন্ন মানদণ্ড পূরণ করতে হবে এবং সংস্থা হিসেবে ইইউ-এর আইন ও বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। এর পাশাপাশি, দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মলডোভা ইউরোপীয় মূল্যবোধ এবং সুশাসনের দিকে আরও মনোযোগ দিলে ইইউ-এর সাথে তাদের সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।
মলডোভার ইইউ অন্তর্ভুক্তির পথে রাজনৈতিক জটিলতাও রয়ে গেছে। রাশিয়া মলডোভার ওপর প্রভাব রাখতে চায় এবং তাদের রাজনৈতিক দলগুলো ইইউ অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছে। তবে, মলডোভা জনগণের একাংশ ইইউ-এর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার পক্ষে শক্তিশালী মতামত প্রকাশ করেছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।
মলডোভার জনগণ ইইউ অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট দিয়ে তাদের দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। যদিও এই সিদ্ধান্তে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে ইইউ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মলডোভার অর্থনীতি, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সাথে মলডোভার সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত দেশের জন্য একটি নতুন দিক নির্দেশনা হিসেবে দেখা যায়। তবে, মলডোভা সরকারকে এখনও অনেক কাজ করতে হবে, বিশেষ করে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এবং ইইউ-এর সঙ্গে সংহতি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
Leave a Reply